রবিবার, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪
Homeজাতীয়অপরাধ বিজ্ঞান এর চোখে ধর্ষণ ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থা

অপরাধ বিজ্ঞান এর চোখে ধর্ষণ ও আমাদের সমাজ ব্যবস্থা

আশঙ্কাজনক হারে দেশে বেড়ে চলেছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা। এরই মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। হবিগঞ্জের কিশোরী বিউটিকে দীর্ঘ একমাস আটক রেখে ধর্ষণ করে বাবুল নামের এক উত্ত্যক্তকারী। অবশেষে ভাগ্যের পরিহাসে সেই কিশোরী খুন হয় নিজেরই বাবার পরিকল্পনায়। পাকিস্তান, আফগানিস্থানের মতো বাংলাদেশেও এখন অনার কিলিংয়ের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে, গাজীপুরের শ্রীপুরে এক পিতা তার মেয়ের নির্যাতনের সু-বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়েই জীবন বিসর্জন দেয় রেল-লাইনে। এ ঘটানাগুলোর নেপথ্যে আছে ধর্ষন। খবরের কাগজ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এখন সয়লাব হয়ে থাকে শত-শত তনু, বিউটি আর পুজাদের অব্যক্ত আর্তনাদে। পাঁচ মাসের শিশু কিংবা আশি বছরের বৃদ্ধা কেউই আজকের সমাজে নিরাপদ নয়। পুজার ঘটনা অন্তত তেমনটাই বলে।
ধর্ষণ বর্তমানে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়, ভিকটিম কোন না কোনভাবে ধর্ষকের পূর্বপরিচিত থাকে। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলের নারী ও শিশুরা আশেপাশের লোকজন দ্বারা ভিকটিম হয় বেশি, আবার শহরের দিকে “ডেট রেপ” এর হারও বেশি। একজন ধর্ষক পুরুষ কেবল তার বিকৃত মন মানসিকতার পরিচয়ই বহন করে। ভিকটিমের শারীরিক ক্ষত হয়তো মুছে যায় কিন্তু মানসিক যন্ত্রনা আর কিছু বীভৎস স্মৃতিকে বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন ধরে। আজকের সমসাময়িক সময়েও ধর্ষণকারীর চেয়ে ধর্ষিতাকেই সন্দেহের চেখে দেখা হয় বেশি। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম Post Traumatic Stress Disorder এ ভুগে। হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেকে সুইসাইড করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র এর পরিসংখ্যান মতে ২০১৭ সালে দেশে ৮১৮ জন নারী ধর্ষিত হয়, ৪৭ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং ১১ জন সুইসাইড করে। ২০১৮ সালের প্রথম তিন মাসেই ধর্ষণের শিকার হয় ১৮৭ জন, ১৯ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং সুইসাইড করে ২ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ধর্ষনের ঘটনা ঘটে যথাক্রমে ৫৮, ৬২, ৭১ ও ৬৭ টি। অন্যদিকে, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম এর তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই ১৩৮ টি শিশু ধর্ষনের ঘটনা ঘটে।

আমেরিকার অপরাধ বিজ্ঞানী শেফার বলেন, একজন ধর্ষক যে কারনেই নারীকে ধর্ষণ করুক না কেন, ধর্ষিতা সারাজীবন মনে করেন তিনি মানুষ নন, তিনি এমন একজন যে কিনা আত্মমর্যাদাহীন, অস্তিত্বহীন, অনুভূতিহীন, সম্মানহীন কেউ। অন্যদিকে রেডিকেল তাত্ত্বিকরা ধর্ষণকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটি বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করেন। একদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, অন্যদিকে নারীদের মার্জিনালাইজ্ড অবস্থান ধর্ষণকে যেন আরো ত্বরানিত্ব করছে। অর্থাৎ নারীরা প্রথমত ভিকটিম হচ্ছে সমাজে তাদের প্রান্তিক অবস্থার কারনে। দ্বিতীয়ত, ধর্ষণের ব্যাপকতার আরেকটি কারন হতে পারে মোরালিটির অভাব। যে ব্যক্তি সুষ্ঠু সামাজিকীকরনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠে তার পক্ষে এমন ঘৃন্য বিকৃত অপরাধ করা সম্ভব নয়। একইভাবে নৈতিক শিক্ষার অভাব তৈরী হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই। তৃতীয়ত, শিশুরা ভিকটিম হয় কারন তাদের প্রতিরোধ বা বাধা দেয়ার ক্ষমতা থাকে না। জীবনের মানে বুঝে উঠার আগেই তাদেরকে বীভৎস অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়।

দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৩৭৬ নং ধারায় ধর্ষণের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী ধর্ষককে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ১০ বছরের কারাদন্ড ও জরিমানা প্রদান করা হয়। ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০’ এর ০৯ নং ধারায় ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের কথা বলা আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আইন থাকলেও আইনের কার্যকারিতা নেই বললেই চলে, যার ভয়াবহতা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। আবার ভিকটিম যখন আইনী ব্যবস্থা নিতে যায়, বার বার তাকে অসংলগ্ন প্রশ্নের মাধ্যমে হেয় করা হয়। তবে আশার কথা হচ্ছে, ১২ এপ্রিল হাইকোর্ট ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ ঘোষনা করে এবং রায় প্রদান করে যে, আইনজীবীরা যেন ভিকটিমকে কোন প্রকার অমর্যাদাকর প্রশ্ন না করে।

এছাড়া ধর্ষণ মামলায় ডিএনএ টেস্ট বাধ্যতামূলক করে ১৮টি নীতিমালা প্রনয়ণ করে হাইকোর্ট যার ফলে মিথ্যা মামলা বন্ধ হবে এবং প্রকৃত ভিকটিমরা উপকৃত হবে। কিশোরগঞ্জের চার বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে শাহ-আলম নামে এক যুবককে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছে আদালত-সাম্প্রতিক এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিগুলোকে সামনে আনা জরুরী যাতে অপরাধীরা বিচার ব্যবস্থার কঠোরতা ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারে। কিছুদিন আগে রাজধানীর তুরাগ পরিবহনে ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীর শ্লীলতাহানির অভিযোগে উত্তরা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্টরা প্রতিবাদের আওয়াজ তুলে এবং অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়। আমাদেরকেও একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা তৈরি করতে হবে নিজের ঘর থেকে, সামাজিকীকরনের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে, নৈতিক অবরোধ তৈরি করতে হবে। ভিকটিম ব্লেমিং বন্ধ করে বিচার ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং “ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার” এর সেবা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে এক সময় এসিড ভিকটিম এর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেলে সরকার কঠোর হস্তে তা নিয়ন্ত্রণ করে।

বর্তমান সমাজে ধর্ষণ যে মহামারীর রুপ নিয়েছে তা নির্মূল করতে সরকারের জিরো টলারেন্স পলিসি অনুসরন করা উচিৎ। ধর্ষণ যে একটা সিরিয়াস অফেন্স এই বোধটা সবার মাঝে তৈরি করতে হবে। আইনের কঠোর অনুশাসন মেনে, ধর্ষিতাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে পঁচে যাওয়া সমাজটাকে আবার নতুন করে মূল্যবোধপূর্ণ, পরিচ্ছন্ন সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। পরিচিত একটি বাক্য দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই যার বাস্তবায়ন খুবই দরকার “ধর্ষিতাকে নয়, ধর্ষণকে ঘৃনা করুন”।

লেখক:
নাফিসা তাবাস্সুম বৃষ্টি
শিক্ষার্থী,
ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ,
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল।
ই-মেইল: – nafisabristi69@gmail.com
ফোনঃ ০১৭০৯-১৮৪২০১

নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

- Advertisement -
- Advertisement -