ড. হারুন রশীদ
চলছে দাবদাহ। জনজীবন অতিষ্ঠ গরমে। প্রকৃতির এই বৈরী আচরণের জন্য মনুষ্যসৃষ্ট অনেক কারণকেই দায়ী করা হচ্ছে। মানুষ প্রকৃতির ওপর নানাভাবেই খবরদারি করছে। খাল-বিল, নদী-নালা দখল করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে বানানো হচ্ছে সমতলভূমি। কৃষিজমিও নষ্ট করা হচ্ছে ঘরবাড়ি বানিয়ে। নানাভাবেই চলছে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার; যে কারণে বৈরী হয়ে উঠছে প্রকৃতি।
প্রকৃতির ওপর মানুষের নির্বিচার অত্যাচারের কারণে প্রকৃতি বৈরী হয়ে উঠেছে। ফলে প্রকৃতির মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রতিশোধপরায়ণতা। আর একে প্রতিশোধপরায়ণতাই বা বলি কী করে! পাহাড়ের ওপর থেকে গাছ কেটে, ট্রাকে ট্রাকে মাটি কেটে পাহাড়কে ন্যাড়া করে ফেললে বৃষ্টিবাদলায় তার ধসে পড়া ছাড়া আর কি কোনো উপায় থাকে? আর পাহাড়ের ঢালুর নিচে যেসব অসহায় মানুষ বসতি স্থাপন করে তাদের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়।
পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ হলেও আশ্চর্যজনক হচ্ছে এই পাহাড়েরও মালিক আছে! এই তথাকথিত মালিকরাই পাহাড় কেটে মাটি লুট করে। পাহাড়ের ঢালু জায়গায় অসহায় মানুষদের থাকতে বাধ্য করে। তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় হয়। এতে রয়েছে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য। সরকার যাবে, সরকার আসবে। কিন্তু পাহাড় দখলকারীদের গায়ে ফুলের টোকা পড়বে না। কারণ যারা দখলদারি চালায় তারা জানে ভাগবাটোয়ারা কোন পর্যন্ত পৌঁছাতে হয়। তাই খোদ সরকারের নির্দেশও কার্যকর হয় না।
চট্টগ্রামের ১২টি পাহাড়কে ভূমিধসের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সরকারিভাবে গঠিত তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও কক্সবাজার পৌরসভার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলোতে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেই সুপারিশ কার্যকর হয়নি আজও। শুধু তা-ই নয়, পাহাড় না কাটার কোনো নির্দেশও বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) ও (সংশোধিত) ২০১০-এর ৪ নম্বর ধারার ৬-খ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কর্তন বা মোচন করা যাইবে না। ’ শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্রীয় আইনে পাহাড় কাটার জন্য দুই বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটা বা ধসের কারণে শত শত মানুষের জীবন গেলেও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো নজির নেই।
লাখ লাখ বছরের ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এই পাহাড়গুলোর বেঁচে থাকাটাও সমান জরুরি। কিন্তু মানুষ তার হিংস্র থাবা বসিয়েছে পাহাড়ের ওপর। বাংলাদেশ এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে। তার ওপর পাহাড় কাটার কারণে ভূমিকম্পঝুঁকি বাড়ছে। দিন দিন আমাদের জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা দখলের ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। এর পানিও এখন মারাত্মক বিষাক্ত। ঢাকার চারপাশের অপর তিনটি নদীর অবস্থাও সঙ্গিন। অবস্থা দেখে মনে হয়, চারদিকে যেন দখলদারির প্রতিযোগিতা চলছে। দখল-দূষণের বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান ও সামান্য জেল-জরিমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে সব কিছু। অথচ পরিবেশ সচেতনতার এই যুগে নদী-খালের দখল-দূষণ বন্ধ ও যথাযথভাবে তা রক্ষা করা সময়ের দাবি। এমনকি দেশের নদ-নদী রক্ষায় উচ্চ আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দখলকারীরা এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের টিকিটি স্পর্শ করাও দুষ্কর। দখল-দূষণ বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঝেমধ্যে অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। তাতে রোগের সাময়িক উপশম হলে ক্যান্সারের মতো স্থায়ীভাবে চেপে বসা রোগ থেকেই যায়।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির ওপরই এ দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশেষ করে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে যে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্যের দরকার হয় তা আসে কৃষিজমি থেকেই। কিন্তু দিন দিন এই জমি কমে যাচ্ছে। কৃষিজমির পরিমাণ এতটাই দ্রুত কমছে যে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় কৃষিজমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দরকার হলে এ ব্যাপারে আইন করে হলেও কৃষিজমি রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধিই কৃষিজমি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরবাড়ি; যার বেশির ভাগই তৈরি হচ্ছে কৃষিজমিতে। এ ছাড়া জনসংখ্যা বাড়ার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য ক্ষেত্রে। নতুন রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ করতে হচ্ছে। বাড়ছে শিল্প-কারখানা। এসবের জন্য কৃষিজমিই ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভাঙনের ফলেও কৃষিজমি কমছে। এসব কারণে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে কৃষিজমি রক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিবছর দেশে কৃষিজমি কমছে ৮২ হাজার হেক্টর, যা মোট জমির ১ শতাংশ। কৃষিশুমারি ১৯৮৪ ও ২০০৮-এর মধ্যে তুলনা থেকে দেখা যায়, চাষকৃত এলাকার পরিমাণ কমেছে সাত লাখ ৩৩ হাজার একর, অর্থাৎ ২৪ বছরে ৮.৮ শতাংশ। কৃষিজমি যে হারে কমছে, তাকে উদ্বেগজনক বলছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষজ্ঞের মতে, প্রতিবছর দেশের জনসংখ্যায় যোগ হওয়া নতুন মুখের জন্য সাড়ে তিন লাখ টন বাড়তি চালের দরকার হয়। একদিকে খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া; অন্যদিকে কৃষিজমি কমে যাওয়া রীতিমতো উদ্বেগজনক ব্যাপার। এ অবস্থায় জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
সীমিত আয়তনের বাংলাদেশে জমি খুবই মূল্যবান; এখানে ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রতি ইঞ্চি জমি হিসাব করে ব্যবহার করতে হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়ণের কারণে দেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। আবাদি জমি কমে যাওয়ার কারণে বছরে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হচ্ছে। আবাদি জমি যেভাবে কমছে, তাতে দেশে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই সারা দেশে জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের পাশাপাশি জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা ও সচেতনতা দরকার। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন ও পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে দেশে সংরক্ষিত কৃষিজমি ও বনভূমির পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নগরায়ণ ও উন্নয়ন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে জমির পরিকল্পিত ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই।
পরিবেশ সচেতনতার এ যুগে পরিবেশদূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই। এমনিতেই জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত হুমকির মুখে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় পরিবেশ রক্ষায় আন্তরিক হতে হবে। সেটা পাহাড় কাটা, কৃষিজমি রক্ষা, হাইটেক পার্ক, নদীদখল, সুন্দরবন রক্ষাসহ যেকোনো বিষয়েই হোক না কেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
harun_press@ayhoo.com