নিউজ ডেস্ক: কালিহাতী উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৪ আসনে নির্বাচনী প্রচার জমে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে পাড়া, মহল্লা, হাটবাজারে মানুষের কাছে যাচ্ছেন। নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। কেন্দ্রের সঙ্গেও লবিং চলছে সমানতালে।
হেভিওয়েট প্রার্থী কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর প্রার্থী হওয়ারও জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। এলাকায় তিনি নিয়মিত সভা-সমাবেশ করছেন। তবে তিনি একক না জোটগতভাবে ভোটে অংশ নেবেন তা স্পষ্ট নয়।
স্বাধীনতার ইশতেহারের পাঠক ও সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান সিরাজের অসুস্থতা এবং আওয়ামী লীগ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর বহিষ্কারের ফলে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপিসহ ৪ জন ও বিএনপির ৬ জন প্রার্থী মনোনয়নযুদ্ধে মাঠে।
তবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী এমপির সঙ্গে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠান্ডুর সঙ্গে বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। নেতাকর্মীরা বিভক্ত। লতিফ সিদ্দিকীর পদত্যাগের পর ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারির উপনির্বাচনে এমপি হন হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী।
আইনি মারপ্যাঁচে পড়ে ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি কাদের সিদ্দিকী। উপনির্বাচনের পর থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিরোধের শুরু। তবে এমপি হওয়ার পর সোহেল হাজারীও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে অবস্থান সংহত করার চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায় মোজহারুল ইসলাম ছাড়াও আছেন জেলা পরিষদের সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু নাসের।
এদিকে নানামুখী চাপে বিএনপি অনেকটা নিষ্ক্রিয় হলেও ভেতরে ভেতরে ভোটের প্রস্তুতিও চলছে। মনোনয়ন নিয়েও নেতাদের মধ্যে বিভক্তিও রয়েছে। গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি লুৎফর রহমান মতিন, শাহজাহান সিরাজের স্ত্রী ও কেন্দ্রীয় তাঁতীবিষয়ক সহ-সম্পাদক রাবেয়া সিরাজ, কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের সহসভাপতি ও ঢাকা মহানগর মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার আবদুল হালিম মিঞা, মালয়েশিয়ার বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার বাদলুর রহমান বাদল, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রনেতা বেনজীর আহমেদ টিটো ও এলেঙ্গা পৌর বিএনপির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র শাফী খান।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোজহারুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতি করি মানুষের সেবা করার জন্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কারা নির্যাতন সহ্য করেছি। পিছপা হইনি। দলকে সংগঠিত করতে দলের সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব। আগামী নির্বাচনে এ আসন থেকে মনোনয়ন চাইব। বর্তমান এমপির সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্প্রতি প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের বিশেষ সভায় এমপিকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে না।
ক্লিন ইমেজের নেতা ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী দান অনুদান দেয়া ছাড়াও ব্যাপক গণসংযোগ করে এলাকার প্রিয়পত্রে পরিণত হয়েছেন। লিয়াকত আলী যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিলে নৌকা সজজেই জয়লাভ করবে। আমার প্রতি তৃণমূলের আস্থা আছে। মনোনয়ন পেলে সব বিভেদ দূর হয়ে যাবে।
সোহেল হাজারী যুগান্তরকে বলেন, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ অনেক শক্তিশালী। আগামী নির্বাচনে নৌকা জয়লাভ করবে। বিভক্তির ব্যাপারে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বৃহতম রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনেকেই মনোনয়নের চেষ্টা করবেন। এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কাজ করার দাবি করে তিনি বলেন, যমুনা নদীভাঙনে গাইড বাঁধ নির্মাণে দরপত্র প্রক্রিয়াধীন। জোকারচরে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতু নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। কালিহাতীর মানুষ আগে এমপির পেছনে ঘুরতেন। এখন এমপি ঘোরেন মানুষের পেছনে। মনোনয়নের ব্যাপারে আমি আশাবাদী।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক আবু নাসের যুগান্তরকে বলেন, মনোনয়নের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। গণসংযোগ করছি। বর্তমান এমপির সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু স্বার্থকেন্দ্রিক লোক নিয়ে তিনি সব সময় চলাফেরা করেন। তাছাড়া তিনি নিয়মিত মিথ্যাচার করেন।
২০০৮ সালে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির লুৎফর রহমান মতিন ৮৬ হাজার ৯১২ ভোট পেয়ে হেরে যান। মতিন যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির মতো বড় দলে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকতেই পারে। সবাইকে নিয়েই কাজ করতে চাই। দল বিচার-বিশ্লেষণ করেই মনোনয়ন দেবে, আমি শতভাগ আশাবাদী। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে অব্যশই বিজয়ী হব। তৃণমূল নেতাকর্মীরা আমার সঙ্গে আছে।
রাবেয়া সিরাজ বলেন, আমার স্বামী শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ৪ খলিফার এক খলিফা। ৫ বার এমপি, ২ বার মন্ত্রী ছিলেন। কালিহাতীর এমন কোনো গ্রাম নেই তিনি উন্নয়ন করেননি। কালিহাতীকে তিনি আধুনিক উপজেলায় রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এলাকার উন্নয়নে আমি ওনার পাশে ছিলাম। স্বামীর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করাই আমার লক্ষ্য। দলের মনোনয়নের ব্যাপারে নেত্রীর প্রতি আস্থাশীল। সিরাজ পরিবার ছাড়া কালিহাতীর আসন বিএনপি পুনরুদ্ধার করতে পারবে না।
স্বাধীনতার সময় উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও করটিয়া কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার আবদুল হালিম মিঞা যুগান্তরকে বলেন, নানা সামাজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়ে ব্যাপকভাবে তিনি এলাকায় পরিচিত। ২০১২ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হন।
বিএনপির দুঃসময়ে নেতাকর্মীরা তাকে কাছে পেয়েছে। নেতাকর্মীদের তিনি ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, দেশে দমন-পীড়নের রাজনীতি চলার পরও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি হলে ভোটাররা আমাকেই বেছে নেবে। আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয় অবধারিত।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী বেনজীর আহমেদ টিটো যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রজীবন থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১/১১-এর দুঃসময় স্থানীয় নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি পালন করি। আস্থা রাখেন এমন একজনকে তারা আগামী নির্বাচনে চাইছে। কালিহাতীর মানুষ আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্ররাজনীতির অভিজ্ঞতার কথা জানে। যে কোনো দুঃসময়ে আমি কর্মীদের পাশে থাকি।
দেশনেত্রী খালেদা জিয়া গ্রেফতার হওয়ার পর কর্মীদের পাশে আছি। মনোনয়ন পেলে আসনটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। উপজেলা বিএনপির সভাপতি লুৎফর রহমান মতিন দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় না আসায় জনগণের সঙ্গে অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। দলের নেতাকর্মীদের বিরোধ মিটিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ করে আমি এ আসনে বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারব।
ইঞ্জিনিয়ার বাদলুর রহমান বাদল যুগান্তরকে বলেন, কালিহাতীর সামগ্রিক উন্নয়ন গত ৪৮ বছরেও পূরণ হয়নি। বারবার দু’জন নেতাকে ভোট দিয়েছে কিন্তু তারা প্রত্যাশিত উন্নয়ন উপহার দিতে পারেনি। তাদের অবর্তমানে কালিহাতীর জনগণ নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত, সৎ, ভদ্র, ডায়নামিক, জনদরদি, নির্লোভী একজন নেতাকে খুঁজছেন। অবাধ, নিরপেক্ষ, সবার অংশ গ্রহণে নির্বাচন হলে বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ভোটে অংশ নেব। এমপি হয়ে উদাহরণ তৈরি করতে চাই।
শাফি খান যুগান্তরকে বলেন, আমার বাবা খলিলুর রহমান এলেঙ্গা ইউনিয়নে ৩৩ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। আমিও ৯ বছর চেয়ারম্যান ও প্রথম এলেঙ্গা পৌর মেয়র নির্বাচিত হয়েছি। পরে কৌশলে আমাকে হারানো হয়েছে। তৃণমূল বিএনপি আমার সঙ্গে রয়েছে। মনোনয়নের ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী। মনোনয়ন দিলে আসনটি পুনরুদ্ধার করা হবে। এ ছাড়া জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম আইন বিষয়ক সম্পাদক প্রফেসর অ্যাডভোকেট আবু তায়েব এলাকায় গণসংযোগ করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আলোচিত টাঙ্গাইলের কালিহাতী থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, ১৯৭৩, ১৯৯৬, ২০০৮ ও ২০১৪ সালে এমপি হন। শাহজাহান সিরাজ ২০০১ সালের বিএনপি থেকে এমপি হন। প্রবাদ চালু আছে যে, এর আগে এ আসনে যে দল থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন সে দলই সরকার গঠন করেছে। ১৩ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৪ আসনে মোট ভোটার দুই লাখ ৯০ হাজার ৫৫ জন। এর মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা এক লাখ ৪৬ হাজার ৮০০।
সূত্র: যুগান্তর
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।