বৈশাখী ভাতা চালুর ২ বছর শেষ হলো। সরকারী চাকুরীজীবীগণ দুটি বৈশাখী ভাতা পেলেন। বৈশাখী উৎসব আমাদের দেশে নতুন নয়। দেশের কোথাও এটা হরব, কোথাও বৈশাখী, কোথাও বোশেখ, কোথাও বৈশাবী, কোথাও হালখাতা প্রভৃতি নামে পরিচিত।
সাধারণত পাহাড়ের আধিবাসীগণ এই উৎসবকে বৈশাবী উৎসব হিসাবে পালন করে। কিন্তু বৈশাখী ভাতা একটি নতুন ধারণা যা ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। নানান ধর্মের, নানান বর্ণের, নানা গোত্রের, নর-নারী, শিশু-কিশোর-কিশোরী নানান সাজে সজ্জিত হয় এ দিনটিতে। এদিনের খাদ্যেও বৈচিত্র রয়েছে।
কাঁচা কাঁঠাল, কুমড়া ,কলার ভূগা, কলা, আলু, বরবটি, গাজর, সীম প্রভৃতি শবজি মিলিয়ে একধরনের খাবার রান্না হয়। যা পাচঁ মিশালী হিসাবে পরিচিত। তাছাড়া পান্তা ভাত আর ইলিশ মাছ তো আছেই । পহেলা বৈশাখের যে মেলা হয় তাতে শিশু কিশোরদের জন্য মাটির তৈরি নানান ধরণের খেলনা, মাটির পুতুল, ঘরগৃস্থালীর খেলনা, মাটির হাতি, মাটির ঘোড়া, মাটির মূর্তি প্রভৃতি বিক্রি করা হয়।
এদিন সরকারী ছুটির দিন । প্রত্যেকে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘর থেকে বের হয় বিনোদনের জন্য। এই যে একটি আনন্দের আয়োজন তাতে প্রত্যেক পরিবারে বাড়তি খরচের প্রয়োজন পড়ে ; নতুন পোষাক, খাবারের আয়োজন, খেলনা দ্রব্য ক্রয়, পরিবার নিয়ে বিভিন্ন স্থানে-মেলায় গমন প্রভৃতিতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। তাই বৈশাখী ভাতার প্রচলন নিঃসন্দেহে প্রশংসার-ধন্যবাদের। যে বা যারা ভাতা প্রচলনের সাথে যুক্ত তাদের ধন্যবাদ। কিন্তু বৈশাখী ভাতা এক জায়গায় এসে সীমাবদ্ধ থেকেছে। কেমন যেন থেমে গেল। আর অগ্রসর হতে পারলাম না ।
এদেশে প্রায় পাচঁঁ লক্ষ এমপিওভূক্ত শিক্ষক কর্মচারী রয়েছে। দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে এদের অবদান প্রায় নব্বই শতাংশ । অন্যদিকে সরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান কম হলেও একমাত্র সরকারী চাকুরীজীবি বলেই তারা ভাতা প্রাপ্তি হন। এমপিওভূক্তগন বঞ্চিত হন। এমপিও ভূক্তির ধারণা আবিষ্কার এবং চালুর পর থেকে এরা সরকারী শিক্ষক বৃন্দের মত একটি জাতীয় বেতন স্কেলে চাকুরীতে সম বেতন স্কেলে চাকুরী করে আসছেন। সরকার হতে স্কেলের নির্দিষ্ট হারে বেতন পেতে পেতে বর্তমানে শতভাগ বেতন সরকার হতে পাচ্ছেন।
সরকারি শিক্ষকবৃৃন্দ তথা চাকুরিজীবিগন যখন ১০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতা পেয়ে ছিল তখন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীগণ ৯০ শতাংশ বেতন পেতেন বলে নব্বই শতাংশের দশ ভাগ মহার্ঘ্য ভাতা পেয়ে ছিলেন। এই হিসাবে বর্তমানে শতভাগ সরকারী কোষাগার হতে বেতন ভোগকারী এই শিক্ষক সমাজ অন্যদের ন্যায় বিশ ভাতা বৈশাখী ভাতার ন্যায্য দাবীদার। অথচ তারা বঞ্চিত। এটা সরকারের জন্য যেমন লজ্জাজনক ঘটনা তেমনি সরকারের ব্যর্থতাও বটে।
একজন সাবেক শিক্ষা সচিব এমপিও ভূক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের বৈশাখী ভাতা না পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক জাতীর মেরুদন্ড গড়ার কারিগর শিক্ষকরা বৈশাখী ভাতা পাচ্ছেন না। গত বছর না পাওয়ার অভিজ্ঞতার আলোকে এ বছর আগে ভাগেই উচিত ছিল পদক্ষেপ নেয়া।” গত ৯ এপ্রিল ‘১৭ খ্রিঃ তারিখে রাষ্ট্রীয় অতিথী ভবন পদ্মায় প্রাক-বাজেট আলোচনা শেষে একটি অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, “সব সরকারী চাকুরিজীবিরা বৈশাখী ভাতা পাচ্ছেন, তাহলে এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরা কেন পাবেন না? ”অর্থমন্ত্রী বয়জ্যৈষ্ঠ নাগরিক, তিনি অভিজ্ঞ আমলা, অভিজ্ঞ মন্ত্রী; তাকে শিক্ষক সমাজ শ্রদ্ধা করেন।
কিন্তু শিক্ষক সমাজের প্রশ্ন তিনি কার নিকট প্রশ্ন করেছেন? তারা মনে করেন শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রণালয় দুটি বৈশাখী ভাতা হতে এমপিওভুক্ত কর্মচারীদের বঞ্চিত করছেন। তাই দুটি মন্ত্রণালয় হতে যে বক্তব্য আসুুক না কেন তারা তাদের দায় এড়াতে পারেন না। শিক্ষক সমাজ মনে করেন বৈশাখী ভাতা এমপি ভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের প্রদানের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাব ছিল । এমপিও ভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীবৃন্দের শতভাগ বেতন ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু সুবিধা স্বল্প আংগিকে হলেও সরকার হতে পেয়ে আসছেন; চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া, সময় সময় মহার্ঘ্য ভাতা, উৎসব ভাড়া প্রভৃতি। কিন্তু বৈশাখী ভাতা কেন এরা পাবেনা তার কোন যৌক্তিক কারণ নেই এবং সরকার হতে এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও নেই। বৈশাখী ভাতা যেমন আর্থিক বিবেচনায় শিক্ষকদের প্রয়োজন তেমনি এর সাথে শিক্ষক কর্মচারীদের মর্যাদাও জড়িত । পাশাপাশি অবস্থানরত চাকুরিজীবীদের সন্তানদের কেউ বৈশাখী ভাতার সুবাধে নতুন নতুন বৈশাখী পোষাকে সজ্জিত হচ্ছে আর কারো সন্তান তা পাচ্ছে না বিষয়টি অমানবিকও বটে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে নব্বই শতাংশ অবদানকারী শিক্ষক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহন ছাড়া এ দেশকে কি সরকার মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পারবে তা ভাববার প্রয়োজন রয়েছে। কেমন যেন দ্বৈত নিয়মের মধ্যে পড়ে গেল এমপিও ভুক্ত শিক্ষা সমাজ। এরা সারা জীবনে একটা ইনক্রিমেন্ট পেত। কিন্তু ৮ম জাতীয় স্কেল কার্যকরি হওয়ার সাথে পাঁচ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির যে নিয়ম চালু করা হয় তা সরকারী চাকুরীজীবিগন পেলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারী বৃন্দ পাননি; উপরন্তু তাদের সারা জীবনে পাওয়া একটি ইনক্রিমেন্ট বন্ধ হয়ে যায়।
যতই নতুন নতুন সংস্কার আসে ততই এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীবৃন্দ নতুন নতুন বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। শিক্ষকবৃন্দের নিকট আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষার উন্নয়ন, সুনাগরিক তৈরি প্রভৃতি আর রাষ্ট্রের নিকট আমাদের প্রত্যাশা শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী বৃন্দের ন্যায্য অধিকার প্রদান। কিন্তু রাষ্ট্র যদি শিক্ষাকে দুটি ক্যাটাগরীতে বিভক্ত করে কাউকে বুকের আর কাউকে পিঠের বিবেচনা করে তাহলে পিঠের অংশ নয়ন জলে এ সমাজকে ভিজিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। শিক্ষকবৃন্দ পদমর্যাদার দিক থেকে যে শ্রেণির হোন না কেন বা সরকারী কোষাগার হতে যে যেভাবে অর্থ প্রাপ্ত হোন না কেন একই সুবিধা সমাজ প্রত্যাশা করে।
মনে রাখতে হবে বৈষম্য থেকে তিক্ততা সৃষ্টি, তিক্ততা থেকে সম্পর্ক নষ্ট হয়, এরপর শুরু হয় অধিকার আদায়ের আন্দোলন। যাদের প্রত্যাশা করি বিদ্যাপীঠে, চক-বুরুজ হাতে শিক্ষার্থীর সম্মুখে, বক্তৃতা শুনি শ্রেণী কক্ষে ; অথচ তাদের বক্তৃতা যদি শুনতে হয় মাঠে-ময়দানে, রাজপথে, শরীরে পুলিশী আঘাত তাহলে লজ্জা কার ? ভেবে দেখতে হয় বুকে কি পরিমাণ আঘাত নিয়ে এরা স্লোগান মুখে তুলে নেয়, শ্রেণিকক্ষ ছেড়ে এরা রাজপথে উপস্থিত হয়!
পাহাড় যদি নিজকে ছিঁড়ে নদী সৃষ্টি করতে পারে তাহলে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীগনও আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে। পূর্বে শিক্ষক আন্দোলনে আত্মত্যাগের ইতিহাস তাদের জানা আছে। তাই ঘটনা জটিল রূপ ধারণ করার পূর্বে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের ৫ ভাগ বর্ধিত বেতন, বকেয়াসহ বৈশাখী ভাতা প্রদান, পূর্নাঙ্গ উৎসব ভাতা, মহানগর শিক্ষকদের জন্য মহানগর ভাতা এবং শিক্ষকদের পদমর্যাদা প্রদান করে সরকার শিক্ষার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এমন প্রত্যাশা রইল।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।