বৃহস্পতিবার, জানুয়ারি ১৬, ২০২৫
Homeটাঙ্গাইল জেলাকালের সাক্ষী সখীপুরের  ২’শ বছরের পুরনো বটগাছ

কালের সাক্ষী সখীপুরের  ২’শ বছরের পুরনো বটগাছ

 

এম সাইফুল ইসলাম সাফলু :

কালের সাক্ষী হয়ে ২’শ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে টাঙ্গাইল জেলার সখীপুর উপজেলার কালিদাস বাজারের বট গাছটি। শুধু এটিকে বট গাছ বললে ভুল হবে এ গাছ শত বছরের স্মৃতি। পুরো বাজার ছড়িয়ে পড়েছে গাছটির বিশাল শাখা-প্রশাখা। শিকড়-বাকড়ে ছেয়ে গেছে পুরো বাজার এলাকা। আজও বট গাছটি রয়েছে তাজা তরুণ আর চিরসবুজ। যেন বার্ধক্যের ছাপ একটুও পড়েনি তার গায়ে। আর সে কারণেই এ বট গাছকে ঘিরে রয়েছে নানা রহস্য নানা ঘটনা নানা স্মৃতি আর স্মৃতি বংশপরম্পরায় চলে এসেছে। এ গাছের ডালপালা যেমন চারদিকে যেমনটি বিছিয়ে গেছে তেমনি এর গল্প-কাহিনী আর কল্পগাথাও বছরের পর বছর ধরে ডালপালা গজিয়েছে। এসব কারণে এ গাছটিকে দেখতে আসে টাঙ্গাইলসহ আশ পাশের জেলার অনেক দর্শনার্থী। গাছটির বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণ করেন অনেক ইতিহাস অনুসন্ধানীরা। এসব বিবেচনায় এলাকাবাসীর দাবি উঠেছে গাছটিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে টিকিয়ে রাখার। এটি একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবেও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি সচেতন মহলের। ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক দুর্লভ স্মৃতি এ গাছটি মূল্যবান উপাদান হতে পারে বলে মনে করছেন শিক্ষিতজনেরা। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় গাছটিকে ঘিরে অনেক সময় পূজা-অর্চনাও করে থাকেন।

গাছটির ঝুলন্ত লতা আর শেকড় নেমে শত শত গাছের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আবার মান্নত বা মনের আশা পূরণের জন্যও গাছটিকে বেছে নেয়। মুসলিমরা গাছটিকে উপকারী বৃক্ষ হিসেবে সমীহ করে। রোববার আর বুধবার সপ্তাহিক বাজার বসে এখানে। বাজারে আসা হাজারো ব্যবসায়ী ও পথিক বটগাছের শীতল ছায়ায়ই বিশ্রাম নেন। ডাল-পাতায় পরিপূর্ণ গাছটি যেন পথিকের বিশ্রামের আশ্রয়স্থল। দর্শনার্থী আর বৃক্ষপ্রেমিকরা এ গাছটিকে জড়িয়ে বা ডাল পালায় হাত লাগিয়ে ছবি করে প্রচার করে থাকেন। বটগাছটি একের পর এক ঝুরি নামিয়ে বিরাট আকার ধারণ করেছে। এই বিস্তৃত বটগাছের দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখীর কল-কাকলি মুখরিত শীতল পরিবেশ বিমুগ্ধ চিত্তকে বিস্ময় ও আনন্দে অভিভূত করে।এ গাছটি শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয় এ যেন দর্শনীয় আশ্চর্য্যের কোন উপাদান। পাঁচ একরের অধিক জমির উপরে এ গাছটি দর্শনার্থীদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। মূল বটগাছটি থেকে নেমে আসা প্রতিটি ঝুড়িমূল কালের পরিক্রমায় এক একটি নতুন বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। ঝুড়িমূল থেকে সৃষ্ট প্রতিটি বটগাছ তার মূল গাছের সাথে সন্তানের মতো জড়িয়ে আছে। কথিত আছে বটবৃক্ষের নীচে বসে শীতল বাতাস গায়ে লাগালে নাকি মানুষও শতবর্ষী হয়।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বট গাছ ইংরেজী: Indian banyan), (বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus benghalensis) ফাইকাস বা ডুমুর জাতীয় গোত্রের উপগোত্রের সদস্য, এর আধি নিবাস বঙ্গভূমি বাংলাভাষী অঞ্চল, এটি একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ বট গাছ সাধারণত দুই প্রকার’ই বেশি দেখা যায়, কাঁঠালি বট ও জিরা বট। বট গাছ খুব বড় জায়গা জুড়ে জমির উপর সমান্তরাল শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে যারা স্তম্ভমূলের উপর ভর দিয়ে থাকে। স্তম্ভমূল প্রথমে সরু সরু ঝুরি হিসেবে বাতাসে ঝলে। পরে মাটিতে প্রেথিত হলে স্তম্ভমূলের মাটির উপরের অংশ বিটপে পরিবর্তিত হয়। বট গাছ চেনে’না এমন লোক নাই বললে চলে। বটের পাতা একান্ত, ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জল সবুজ। কচি পাতা তামাটে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে পাতার আয়তনের বিভিন্নতা একাধারে বটের বৈশিষ্ট্য তথা প্রজাতি শনাক্তকরণের পক্ষে জটিলতার কারনও। পরিণত গাছের পাতা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে আসে। বটের কুঁড়ি পাংশুটে হলুদ এবং এর দুটি স্বল্পায়ু উপপত্র পাতা গজানোর পরই ঝরে পড়ে। খুব অল্প বয়স থেকেই বট গাছের ঝুরি নামতে শুরু করে। মাটির সমান্তরালে বাড়তে থাকা ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কান্ডে পরিণত হয়। এভাবেই বট গাছ ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকে এবং একসময় মহীরুহে পরিণত হয়। বসন্তও শরৎ বট গাছে নতুন পাতা গজানোর দিন। এসময় কচি পাতার রং উজ্জল সবুজ থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত হলো ফল পকার সময়। বট ও বট জাতীয় গাছের বংশ বৃদ্ধির পদ্ধতি ও কৌশল প্রধানত অভিন্ন। মঞ্জরির গর্ভে ফুলগুলো লুকানো থাকে। ফুলগুলো খুবই ছোট এবং ফলের মতোই গোলাকার। একলিঙ্গিক এই ফুলগুলো পরাগায়নের জন্য বিশেষ জাতের পতঙ্গের উপর নির্ভরশীল। পাখিরা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয়। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিস, পুরানো দালানের ফাটল ও অন্য কোন গাছের কোটরে সহজেই অঙ্কুরিত হয় এবং আশ্রয়কে গ্রাস করে ফেলে।একারনে উপগাছা বা পরগাছা হিসেবেও বটের বেশ খ্যাতি আছে। এই বট এমনই একটা গাছ তার ফল হইতে বীজ সংগ্রহ করে বপন করলে গাছ জন্মায় না। আবার কোন দালানের কার্নিস হইতে তৈরি গাছ উঠিয়ে এনে রোপণ করলো হয়।উপযুক্ত পরিবেশে একটি গাছ পাঁচ(৫)থেকে ছয়(৬)শত বছর বেঁচে থাকতে পারে। বট বাংলা অঞ্চলের আধিমতম বৃক্ষ।

স্থানীয় শতবর্ষী বয়সী আবুল কালাম মিঞা বলেন, বাপ-দাদার আমল থেকেই দেখে আসছি এই বটগাছ। দিন দিন বট গাছ বিলুপ্তির পথে। তিনি স্থানীয় বণিক সমিতিসহ সংশ্লিষ্টদের গাছটি রক্ষনাবেক্ষনের দাবি জানান।

মানবাধিকার কর্মী কালিদাস গ্রামের সাইফুল ইসলাম শিবলু জানান, দাদার কাছে শুনেছি এ গাছের ডালপালা কাটা যেত না। এমনকি ভয়ে কেউ পাতাও ধরত না। সেই ভয়ে এখনো অনেকে গাছের ডালপালা ভাঙে না। যখন গাছে ফল পেকে যায় তখন দেখতে দারুণ লাগে। লাল রঙে ছেয়ে যায় পুরো বাজার। ঐতিহ্যবাহী এ বটগাছটি সংরক্ষিত করা হলে দিন দিন পর্যটকদের আনাগোনা বাড়বে বলে তিনি দাবি করেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া সেলিম স্থানীয়দের কাছে দীর্ঘদিনের স্মৃতি বিজরিত এ গাছটিকে রক্ষণাবেক্ষনের দাবি জানান।

 

নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

- Advertisement -
- Advertisement -