চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না। বসিরকে হত্যার পর, ভিখুর গলা জড়িয়ে তার পিঠে ঝুলতে ঝুলতে যখন পাঁচী নবমীর চাঁদকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার প্রাগৈতিহাসিক গল্পে এখানে যে অন্ধকারের বর্ণনা দিয়েছিলেন, পৃথিবীর আলো আজও তার নাগাল পায়নি। আর পায়নি বলেই এখনও আমাদের দেখতে হচ্ছে অসহিষ্ণুতা।
২ আগস্ট সংবাদত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, বিয়ের আসরে প্রেমিকার বাবাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত বিবরণ থেকে জানা যায়, প্রায় দশ বছরের ‘প্রেমের’ সম্পর্ক। একসঙ্গে স্কুলে লেখাপড়া করেছে দুজন। একই বাসায় পাশাপাশি থাকত দুটি পরিবার। ফলে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে। একসঙ্গে বেড়ে ওঠায় মনের দূরত্ব কমেছে। যদিও মেয়ের পরিবারের দাবি, এটি কখনই প্রেম নয়। ছেলেটি যেহেতু মেয়েটির চেয়ে বয়সে ছোট, তাই মেয়েটিও সম্পর্ককে প্রেমের দৃষ্টিতে দেখেনি বলেই দাবি। কিন্তু ছেলেটির মন বিষয়টি মানতে পারেনি। একসঙ্গে, পাশাপাশি থাকা এবং পারিবারিক সম্পর্কের কারণে বিভিন্ন সময়ে উভয়ের স্থিরচিত্রও রয়েছে। সেগুলোই ছেলেটি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে, এই অভিযোগও রয়েছে। কিছুদিন আগে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু খুব বেশিদিন সংসার করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ধরে রাখা স্থিরচিত্রগুলো ছেলেটি দেখিয়েছে মেয়েটির স্বামীকে। এতেই কপাল পোড়ে। সংসার ভেঙে যায়। মা-বাবার কাছে ফিরে আসে মেয়েটি। আবারও মেয়েটির বিয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। এতে রেগে গিয়ে মেয়ের বাবা-মাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। সেই হুমকিকেই বাস্তবে রূপ দেয়, মেয়েটির বিয়ের দিনে। বিয়ের আসরেই প্রেমিকার বাবা তুলা মিয়াকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। আহত করে মেয়ের মাকেও। আহতদের চিৎকারে এগিয়ে আসা মানুষ অপরাধীকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। আদালতে অপরাধী স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে বলে পরদিন সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে।
রাজধানীতে ঘটা শুধু একটি ঘটনাই নয়, প্রায় প্রতিদিনই আমরা সম্মুখীন হচ্ছি এ রকম অসংখ্য ঘটনার। কোনোটির বিবরণ খবরের কাগজের পাতায় আসছে, কোনোটি আসছে না। কিন্তু তাতে করে থেমে নেই আমাদের ভেতরের অসহিষ্ণুতা। বরং তা যেন লাগাম ছাড়া হয়ে উঠছে। এ রকম প্রেমের নামেই মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে বরগুনায় প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে রিফাত শরীফকে। যে নৃশংসতায় তাকে হত্যা করা হয়, তার ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ শিউরে উঠেছে। মাঝে কিছুদিন সংবাদপত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ও শিশু নির্যাতনের খবর দেখতে দেখতে অসুস্থ বোধ করছিলাম। তার রেশ এখনও থামেনি। এখনও প্রতিদিন সংবাদপত্রে গড়ে চার-পাঁচজন নারী ও শিশু নির্যাতিত হওয়ার খবর থাকে। সামাজিক অসহিষ্ণুতার নানা রূপ এখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। এই তো কয়েক সপ্তাহ আগে ফেনীর সোনাগাজীতে রাফী নামের মেয়েটিকে যেভাবে পুড়িয়ে মারা হলো, সেই নৃশংসতা কি আমরা কখনও কল্পনা করেছি? তবুও আমাদের কল্পনার অতীত নৃশংসতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে হত্যা করা হয়েছে রাফীকে। রাজধানীর বাড্ডায় একজন নিরীহ মহিলাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি নিজের সন্তানকে স্কুলে ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে বেরিয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল, তাকে ছেলেধরা সন্দেহ করা হয়েছে। আর এই অপরাধেই হাজারো মানুষের সামনে অগণিত মানুষ তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। সেই দৃশ্য আবার কেউ কেউ নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। ভিডিও চিত্রটি দেখলেই বোঝা যায়, আমাদের নৃশংসতা কোন স্তরে নেমেছে। মহিলার মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে লাঠি দিয়ে পেটানো, খোঁচানো হয়েছে। সব দেখে শুনে মনে হয়, আমরা কি হারিয়ে ফেলছি আমাদের মূল্যবোধ? আমাদের মাঝ থেকে কি উঠে যাচ্ছে দয়া-মায়া-মমতা শব্দগুলো? এ কোন নিষ্ঠুর সময়ের মধ্যে আমরা প্রবেশ করছি। এ কোন দৃষ্টান্ত একের পর এক স্থাপিত হচ্ছে আমাদের সামনে? আমাদের অধঃপতন কি এতটাই, যে এর থেকে বেরিয়ে আসার আর পথ নেই? দেখে শুনে মনে হয় যেন এক উটোপিয়ার ভেতরে আমাদের বাস। বাংলায় যাকে কল্পলোক বা কল্পরাজ্য বলা হয়, তবে তা সদার্থে। কিন্তু আমাদের এই উটোপিয়া মন্দার্থেই ব্যবহৃত হবে। এই যে একটা অলৌকিক জগতের ভেতর দিয়ে আমাদের যাওয়া, একে যদি জাগতিক স্তরে নিয়ে না আসা যায়, বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে যে ব্যবধান তাকে যদি ঘোচানো না যায়, তবে সামনের বিপদ আরও বড়।
প্রাকৃতিক নিয়মেই মানুষ হিংস্র প্রাণী। এই হিংস্রতা আমাদের মনে। প্রাণী জগতের হিংস্র প্রাণী হিসেবে যাদের খ্যাতি অথবা অখ্যাতি সেই হিংস্রতা তাদের দাঁত ও নখে। সেসব প্রাণীর তুলনায় আমাদের দাঁত ও নখর তীক্ষè নয়। তবুও হিংস্রতায় আমরা সেই প্রাণীদের ওপরে। তাদের হিংস্রতা কখনই স্বজাতির বিরুদ্ধে না। যদি তাই হতো, তাহলে সেই প্রাণীরা এতদিনে পৃথিবী থেকে বিলীন হতে সময় নিত না। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে মোড়ের কুকুরগুলো যখন দাঁত ও মুখ খিঁচিয়ে অন্য কুকুরের দিকে ধেয়ে যায়, তা দেখে মনে হয়Ñ যে কারো জীবন বিপন্ন হবে। কিন্তু কোনো কুকুরের আক্রমণে কোনো কুকুরের মৃত্যু হয়েছে, এমন খবর শুনিনি। আর চোখের সামনে তো দেখিইনি। অথচ চোখে মুখে ও রকম হিংস্রতা ধারণ না করেও আমরা অবলীলায় অন্যের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে পারি। তবে আশার কথা এই যে, আমরা আমাদের হিংস্রতাকে বিভিন্ন বাধা-নিষেধ দিয়ে বেঁধে রাখতেও পারি। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এই গুণটি আয়ত্ত করেছে। তারপরও ব্যক্তিস্বার্থ কখনও কখনও সেই বাধা অতিক্রম করে হিংস্র হয়ে ওঠে। আমাদের সেই বাধার দেওয়ালটিই আজ শক্ত করে বাঁধতে হবে। যাতে করে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে আমাদের ভেতরের পশুত্ব জেগে না ওঠে।
আজ যেভাবে সামাজিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে, তা রীতিমতো আতঙ্কের। আজ আমাদের প্রত্যেকের মাঝে বাড়ছে চাহিদা এবং প্রাপ্তির ব্যবধান। এই ব্যবধান যদি আমরা কমাতে না পারি, আমাদের চাহিদার লাগাম যদি আমরা টেনে না ধরতে পারি, তাহলে ব্যক্তির নিজের ভেতরের সংঘাত অনিবার্য। আর এই সংঘাতই ব্যক্তিকে করে তুলছে অসহিষ্ণু। এই অসহিষ্ণুতা এবং হিংসা যে ব্যক্তিস্বার্থের হিংস্রতায় সব দেওয়াল ভেঙে ফেলছে সমাজের ভেতরে খুব বড় ভাঙনের আগেই তাকে শক্ত বাঁধের ভেতরে আটকাতে হবে। কারণ প্রকৃতিতে মানুষই সেই জীব যার মনে একই সঙ্গে রয়েছে হিংসা এবং প্রেমÑ এ রকম দুই বিপরীত উপকরণ। এই দোষ-গুণের জন্যই মানুষ যেমন ভাই হয়ে ভাইয়ের গলায় ছুরি চালাতে কার্পণ্য করে না, তেমনি নিজের জীবনের বিনিময়েও কেবল মানুষই পারে সজ্ঞানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করতে চাই মহাত্মা গান্ধীর উক্তি, যেখানে তিনি বলেছিলেন,There are chords in every human heart. If we only know how to strike the right chord, we bring out the music.
সাংং