টাঙ্গাইলে কলাগাছের খোসা ও আনারসের পাতা থেকে সোনালী আঁশ

0
198

নিজস্ব প্রতিনিধি: লালমাটির গড় টাঙ্গাইলের মধুপুরে কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে উৎকৃষ্টমানের বেনানা ও পাইন আপেল জুট। এসব সোনালী আঁশ বা জুট নীলফামারী ও ঢাকায় শিল্প কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি করা হচ্ছে কার্পেট, পা-পোস, রশি, ফুলদানিসহ নানাধরণের শৌখিন ও মূল্যবান তৈজসপত্র। কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতার ফাইভারে তৈরিকৃত শৌখিন জিনিসপত্র দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানী করা হচ্ছে।

সুনাম কুড়াচ্ছে বিশ্বজুড়ে। কলা গাছ ও আনারসের পাতার প্রচুর আধিক্য থাকায় মধুপুর গড় এলাকায় এ শিল্পের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এ কাজটি ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছেন মধুপুর উপজেলার শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কাকড়াগুনি গ্রামের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মজিবর রহমানের ছেলে আনোয়ার হোসেন।

সরজমিনে পরিদর্শনে গিয়ে আনোয়ার হোসেন এর সাথে কথা বলে জানা যায়, মধুপুর গড় এলাকা কলা ও আনারস চাষের জন্য বিখ্যাত। এ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে কলা ও আনারস জন্মে থাকে। যে কারণে মধুপুর গড় এলাকাকে কলা-আনারসের রাজধানীও বলা হয়ে থাকে। এ কথা মাথায় রেখে তার এক পরিচিত ঢাকার মোকাদ্দেছ নামের এক লোকের পরামর্শে ২০১৬ সালে শুরু করেন কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা থেকে গোল্ডেন ফাইভার সোনালী আঁশ উৎপাদনের কাজ। তার মাধ্যমে ঢাকা থেকে ৩টি মেশিন ৬ লক্ষ টাকায় ক্রয় করে নিয়ে আসেন।

মেশিন বসান তার বাড়ির আঙ্গিনায়। শুরু করেন কাজ। এ শিল্পের কাঁচামালের জন্য তাকে চিন্তা করতে হয়নি। তার নিজ গ্রামেই প্রচুর পরিমাণে এ শিল্পের কাঁচামাল কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা পাওয়া যায়। কাঁচামাল সংগ্রহ করতে অন্য কোথাও যেতে হয়নি। স্থানীয় প্রান্তিক নারী শ্রমিক ও পুরুষ শ্রমিক দিয়ে কলা ও আনারসের বাগান থেকে সংগ্রহ করেন কাঁচামাল। কাঁচামাল তাকে ক্রয় করতে হয় না। প্রথমে মেশিন চালানোর জন্য চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে শ্রমিক আনেন। ধীরে ধীরে আনোয়ার ও স্থানীয় শ্রমিকরা শিখেন মেশিন চালনা। পরে আরও ২টি মেশিন এনে বসান। এভাবে বর্তমানে ৫টি মেশিন ও ৪০জন নারী-পুরুষ কাজ করেন। খোলে বসেন কারখানা; প্রতিদিন উৎপাদন হয় সোনালী আঁশ বা তন্তু বা ভাইভার।

এভাবে ৪ বছর যাবত তার কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে ফাইভার। প্রতিমাসে শ্রমিক খরচ, পরিবহন যোগাযোগ সব খরচ মিলিয়ে যা ব্যয় তা মিটিয়ে কিছু লাভ পান তা দিয়ে বাড়াচ্ছেন কারখানার পরিধি। চালিয়ে যাচ্ছেন তার কারখানার ফাইভার ব্যবসা। তার বাড়ির আঙ্গিনায় গড়ে তোলা কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি পূর্বপাশে কাকড়াগুনি বাজারের পাশে গড়ে তুলেছেন এ ফাইভার কারখানা। এসব মেশিন একসাথে বসানো হয়েছে। মেশিন ঘরের উপরে ত্রিফলের ছাউনি।

এর নিচে শ্রমিকরা কলা গাছের খোসা ও আনারসের পাতা দিয়ে ফাইভার তৈরি করছেন। পাশেই মেশিনের ভেজা ফাইভার ধোয়ার জন্য পলিথিন বিছিয়ে গর্তের পানির মধ্যে হাউজ করা হয়েছে। এখানে ফাইভার ধুয়ে পরিষ্কার করা হয়। পাশেই বাঁশের আড় বানানো হয়েছে। যেখানে আঁশ বা ফাইভারগুলো রৌদ্রে শুকানো হয়। মেশিন ঘরের পাশেই টিনের ছাপড়া দিয়ে গুদাম ঘর তৈরি করছেন। গুদামে উৎপাদিত মাল রাখা হয়। কারখানার একপাশে কলার বাগান পশ্চিমে পাশে বাড়ী এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ জমির মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার কারখানা।

এ কারখানায় প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরামহীন কাজ চলে। কাকড়াগুনি গ্রামটি মুলত: গারো অধ্যুষিত একটি গ্রাম। এ গ্রামের অধিকাংশ জনগণ গারো সম্প্রদায়ের। কিছু মুসলিমের বসবাস রয়েছে এ গ্রামে। তারা মিলেমিশে একসাথে বসবাস করে আসছে। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবি। তারা আনারস ও কলার চাষ করেন কেউ আবার বাগানে দিনমজুরের কাজ করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠঘাটে খেটে খায়। পাশে মধুপুরের ঐতিহ্যবাহী শালবন। এ বনের উত্তর পাশে ঘেষা এ গ্রামটি। স্থানীয়রা জানালেন, এ গ্রামের মাটি অত্যন্ত উর্বর। এমাটিতে আনারস, কলা, পেপে, আদা, হলুদ, আমসহ নানা কৃষি ফসল উৎপাদন হয়। কলা ও আনারস চাষের সূত্র ধরেই এ কারখানা স্থাপন করেন আনোয়ার হোসেন।

আনোয়ার হোসেন পড়াশুনা করে প্রাইমারী সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ৫ম শ্রেণির আগেই তার পাঠ চুকিয়ে যায়। পাড়াশোনা করতে না পারলেও মেধা ও বুদ্ধিতে তিনি এগিয়ে আছেন। মেধা ও মনন দিয়ে কিভাবে আত্মকর্মসংস্থান ও এলাকার মানুষের কর্মসংস্থান কিভাবে হবে এ বিষয়ে তিনি ভাল বুঝেন। পরিবার গঠনের ক্ষেত্রেও তিনি তার স্বাক্ষর রেখেছেন। সংসারে ২ ছেলে ১ মেয়ে, ছেলেরা তার কাজে সহযোগিতা করে।

আনোয়ার হোসেন(৪৮) জানান, ২০১৬ সালের কথা। তার ঢাকার এক পরিচিত মোকাদ্দেছ নামের এক ব্যক্তি প্রথমে তাকে এ কাজে সহযোগিতা ও উৎসাহ প্রদান করেন। তার সহযোগিতায় সে একাজ শুরু করেন। তার এলাকায় প্রচুর পরিমাণে এ শিল্পের কাঁচামাল পাওয়া যায়। সেজন্য সে এ শিল্প স্থাপনের কাজে এগিয়ে যান। কারখানার চালুর শুরুর দিকে এ কাজ ভাল বুঝতেন না। এখন একাজে সে অভিজ্ঞ। কিভাবে আঁশের মান ভাল ও উৎপাদন বেশি আসবে সে এ ব্যাপারে ভাল বুঝেন। মেশিনে কি করলে আঁশ ভাল হবে সেজন্য মেশিন মেরামত করেন নিজেই। তার কারখানায় প্রতিদিন ৫টা মেশিন চললে আঁশের উৎপাদন আসে ৫০ কেজির মতো। উৎপাদিত কাঁচা আঁশ ভালভাবে হাউজে ধুয়ার পরে রোদে শুকান।

তারপর ভালভাবে শুকানোর পর গুদামজাত করেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত ও মধুপুর শহর থেকে দূরত্ব বেশি থাকার কারণে পরিবহন খরচ বেশি হয়। উৎপাদিত মাল শিল্প কারখানায় পাঠাতে পরিবহন খরচ বেশি হয়। এজন্য তিনি বস্তায় প্যাকেট করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মোকামে পাঠান। তার কারখানায় এখন সব মিলিয়ে প্রান্তিক দরিদ্র ৩০জন নারী ও ১০জন পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। সব মিলিয়ে প্রতিমাসে তার খরচ হয় ২-৩ লক্ষ টাকা। খরচ বাদে প্রতিমাসে তার কিছু লাভ থাকে, তা দিয়ে তার সংসার চলে।

তিনি আরও জানান, অর্থের অভাবে তিনি কারখানার পরিধি বাড়াতে পারছেন না। অর্থের সংস্থান পেলে তিনি কারখানার পরিধি বাড়িয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আরো শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এজন্য তিনি সরকার ও বেসরকারী বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বড় আকারের কারখানা করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও জানান, এ শিল্পের কাঁচামালের কোন অভাব নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পরিপক্ক কলা কাটার পর ফেলে দেওয়া কলা গাছ বাগান মালিকদের কাছ থেকে চেয়ে এনে খোসা উঠিয়ে শ্রমিক দ্বারা ট্রলিতে তুলে বিভিন্ন বাগান থেকে তা কারখানায় আনেন।

এতে শ্রমিক ও পরিবহন খরচ ছাড়া অন্য কোন খরচ নেই। কলার খোসার জন্য কোন অর্থ লাগে না। বিনা পয়সার পাওয়া যায় কাঁচামাল। ঠিক আনারসের পাতা সংগ্রহ করতেও একই অবস্থা। তার এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে মেশিন চালান, এতে খরচ বেশি। যদি বিদ্যুতের ব্যবস্থা হতো তাহলে খরচ আরও কমে আসতো। প্রতিদিন প্রায় ১৫শ টাকার জ্বালানী কিনতে হয়। বিদ্যুৎ থাকলে খরচ অনেকটা কমে আসতো। দুর্গম এলাকা থাকায় রাস্তাঘাট কাঁচা থাকায় সমস্যা হচ্ছে। বর্ষাকালে এ সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। অর্থের অভাবে কারখানার প্রাচীর ও গুদাম ঘর করতে পারছেন না। তার কারখানা ভালভাবে চালনার জন্য মালামাল পরিবহনের একটি গাড়ী, মেশিন বৃদ্ধিসহ নানাকাজ করার জন্য ১০-১৫ লক্ষ টাকা সরকারী ও বেসরকারী পর্যায় থেকে লোন পেলে একাজ করতে পারবেন বলে তিনি জানান। এ সব তথ্য কারখানা মালিক আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে জানা গেছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় শোলাকুড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আকতার হোসেন জানান, শোলাকুড়ি ইউনিয়নটি আনারস ও কলার জন্য বিখ্যাত। আনোয়ার হোসেন যে কাজটি শুরু করেছেন এটি একটি ভাল উদ্যোগ। এ শিল্পে কাঁচামালের অভাব নেই। সরকারী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আনোয়ার হোসেন একটি সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং এর ফলে এলাকার দরিদ্র প্রান্তিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। এ এলাকায় এ শিল্পের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে এই এলাকা অর্থনীতিক ভাবে আরও এগিয়ে যাবে।

মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান জানান, যেহেতু মধুপুরে প্রচুর পরিমাণে আনারস ও কলার চাষ হয় সেহেতু এ শিল্পের কাঁচামালের অভাব হবে না। এ জন্য এই ফাইবার তৈরীর সম্ভাবনা ভাল। এই ফাইবার দিয়ে সৌখিন জিনিস তৈরী হয়। ফাইবারের তৈরীকৃত জিনিস রপ্তানী করতে পারলে সুবিধা বেশি হবে।

নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।