টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল গ্রামে হত্যা মামলা প্রত্যাহার না করায় দুটি পরিবারকে তিন মাস ধরে ‘একঘরে’ করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। পরিবার দুটির সঙ্গে গ্রামের কাউকে সম্পর্ক রাখতে দেয়া হচ্ছে না। প্রভাবশালীদের চাপে এলাকার দোকান-পাট থেকেও তাদের কাছে কোনো পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে না।
ডুবাইল গ্রামবাসী জানায়, গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এই গ্রামের ইয়াসিন মিয়া (৫৩) নামে এক ব্যক্তি খুন হন। ঘটনার পর তার ছেলে শহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে ওই গ্রামের ১২ জনকে আসামি করে দেলদুয়ার থানায় হত্যা মামলা করেন। ঘটনার কিছুদিন পর থেকেই মামলার আসামিদের স্বজনরা গ্রামের প্রভাবশালীদের দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের জন্য নিহত ইয়াসিন মিয়া এবং তার বড়ভাই মৃত মোকসেদ আলীর পরিবারের ওপর চাপ দিতে শুরু করে। কিন্তু মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় ইয়াসিন মিয়ার ছেলে শহিদুল ইসলাম, ভাতিজা আসাদুল ইসলাম ইমনকে হত্যার হুমকি আসে। তারা আসাদুলদের একটি ঘরে আগুন দেয় এবং তাদের বাড়ির পাঁচটি কুকুর মেরে ফেলে।
এরপর নিহত ইয়াসিন মিয়ার ভাতিজা আসাদুল ইসলাম বাদী হয়ে গত ৬ জুন জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আদালতে মামলা করেন। আদালতের সমন হাতে পেয়ে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে হত্যা মামলার আসামি ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা। তারা একত্রিত হয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য কামরুল মিয়া, এলাকার প্রভাবশালী রজব ভূঁইয়া, জালাল ভূঁইয়াসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা গত ২৮ জুলাই গ্রামের মসজিদে সভা করেন। সেখান থেকে নিহত ইয়াসিন মিয়া এবং তার বড়ভাই মৃত মোকছেদ আলীর পরিবারকে ‘একঘরে’ করে রাখার সিদ্ধান্ত আসে। গ্রামের প্রত্যেকের বাড়ি বাড়ি জানিয়ে দেয়া হয়, ওই দুই পরিবারে সঙ্গে কেউ যেন সম্পর্ক না রাখেন। বাদী পক্ষের লোকদের গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়াও নিষেধ করা হয়। এলাকার দোকানগুলোতেও বলে দেয়া হয়েছে, যেন ওই দুই পরিবারের কাছে কেউ কিছু বিক্রি না করেন। এর ফলে দুটি পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তারা।
সরেজমিনে ডুবাইল গ্রামে গিয়ে কথা হয় ওই দুই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। নিহত ইয়াসিন মিয়ার ছেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, “বাবা হত্যার বিচার চেয়ে আজ আমরা নির্যাতিত হচ্ছি। আসামিরা আমাদের একঘরে করে রেখেছে।”
শহিদুলের মা আসমা বেগম জানান, হত্যাকারীরা প্রভাবশালী। তাই তারা মামলা তুলে নেয়ার জন্য ‘একঘরে’ করে চাপ সৃষ্টি করছে। গ্রামের কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। তাই তাদের কথা সবাই মেনে নিয়েছে।
এ বিষয়ে নিহত ইয়াসিন মিয়ার ভাতিজা আসাদুল ইসলাম জানান, গত কোরবানীর ঈদে তাদের গ্রামের ঈদগাঁয় নামাজ পড়তে দেয়া হয়নি। দোকানপাটে কিছু কিনতে গেলে দোকানীরা মাতাব্বরদের ভয়ে কিছু বিক্রি করে না তাদের কাছে।
আসাদুলের মা বেদেনা বেগম জানান, তার ছোট ছেলে গ্রামেই প্রাইভেট পড়ত। তাকে সেখানেও পড়তে দেয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় মানসিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন তারা।
ডুবাইল গ্রামের ‘বাবুল স্টোর’ নামে এক মনোহারী দোকানের বাবুল ভূঁইয়া জানান, ইয়াসিন মিয়া ও মোকসেদ আলীর পরিবারের কাছে কোনো কিছু বিক্রি করতে নিষেধ করেছে সমাজের মাতাব্বররা।
এ প্রসঙ্গে ইউপি সদস্য কামরুল মিয়া জানান, নিহত মোকসেদ মিয়ার ভাতিজা আসাদুল তাদের পরিবারের নিরাপত্তা চেয়ে আদালতে যে মামলা করেছেন, তাতে গ্রামের মানুষদের হয়রানি করা হয়েছে। তাই সমাজের সবাই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অপর প্রভাবশালী জালাল ভূঁইয়া বলেন, “ওই দুই পরিবার তাদের মতো থাকবে, আমরা আমাদের মতো থাকব। তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এটাই সমাজের সিদ্ধান্ত।”
এদিকে, দেলদুয়ার উপজেলার ডুবাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইলিয়াস মিয়া জানান, ওই দুই পরিবারকে ‘একঘরে’ করে রাখার ঘটনাটি তিনি শুনেছেন।