নিউজ টাঙ্গাইল ডেস্ক : টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরী নানা সমস্যা আর অব্যবস্থাপনা-অনিয়মে জর্জরিত। স্বাস্থ্যসম্মত পানি, পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, পরিবেশ, নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অবৈধ দখলদারের কারণে বিপাকে রয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারীরা। নির্মাণের প্রায় তিন যুগ হলেও বিসিক কর্তৃপক্ষের অবেহেলা আর প্রভাশালীদের ইশারায় চলছে টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরী। শিল্প মালিকরা বিভিন্ন সময়ে ছোট-বড় শিল্প গড়ে তুলে উৎপাদনে গেলেও অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না করায় লোকসানে পড়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান।
জানা যায়, ১৯৮৫ সালে টাঙ্গাইল শহরের তারটিয়ায় বিসিক শিল্প নগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৬ সালে প্রায় ২৩ দশমিক ৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জমির মোট ক্রয় মূল্য ধরা হয় ৩৯ দশমিক ৪৬ লাখ টাকা। রাস্তা, প্রশাসনিক ভবন এলাকা ও মসজিদের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ৬ দশমিক ৫০ একর ভূমি। এতে বরাদ্দযোগ্য ১৩২টি প্লটের সবক’টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে শিল্প ইউনিটের সংখ্যা ৬৫টি, চালু রয়েছে ৫৩টি। শিল্প উদ্যোক্তরা এতে প্রায় ১২১ দশমিক ৮৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কর্মসংস্থানের সুয়োগ হয়েছে ৫ হাজার ২৮৫ জনের। এ শিল্প নগরীর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে ২৩৫ দশমিক ১৫ কোটি টাকা। বিসিক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে নিয়োজিত সরকারি খাতের মূখ্য প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৭ সালে সংসদীয় আইনের মাধ্যমে বিসিকের জন্ম। বিসিক এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উদ্যোগে দেশে প্রচুর শিল্পোদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে।
বিশ্বায়ন এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব এই সেক্টরের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পজাত পণ্য বাজারজাতকরণে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দেয়। বিসিক এই সমস্ত বিদ্যমান ও নতুন শিল্পদ্যোগকে সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন করা এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকে। অথচ টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরীর ব্যবসায়ীরা সরকারি তেমন কোন সুবিধা পাচ্ছে না। এ শিল্প নগরী প্রতিষ্ঠাকালে যেসব রাস্তা-ঘাট, পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন করা হয়েছিল তা আর সংষ্কার করা হয়নি। ফলে ড্রেনে ময়লা পানি জমে থাকে। পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে একটু বৃষ্টিতেই হাটু পানি জমে যায়।
এ নগরীতে স্বাস্থ্যসম্মত পানি দেয়ার কথা থাকলেও ময়লা ও মাত্রাতিরিক্ত আয়রনের পানি দেয়া হয়। সেই সাথে রয়েছে ভাঙা রাস্তাঘাট। এদিকে, এ শিল্প নগরীর চারপাশে কয়েকটি পকেট গেট রয়েছে। এতে বাইরের লোকজন যেকোন সময় বিসিকের ভেতরে চলে আসে। আবার বাইরের কিছু বখাটে বিসিকের ভেতরে ঢুকে নারী শ্রমিকদের হয়রানি করার সুযোগ পায়। নগরীতে রাতে মাদকের আসরসহ স্থানীয় বখাটেরা নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। এ নিয়েও কোন মাথা ব্যথা নেই বিসিক কর্তৃপক্ষের। ফলে শিল্প মালিক ও কর্মচারীদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। অনেক সময় ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটে। প্রশাসন থেকে টহল পুলিশের ব্যবস্থা করা হলেও তেমন সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় গুটিকয়েক প্রভাবশালীর কারণে নগরীর বেশ কিছু প্লট বেদখল হয়ে রয়েছে। অনেক মালিকরা লিজ নিয়েও সেসব প্লটগুলোতে কোন কাজ করতে পারছেন না। এ নিয়ে বিসিক কর্তৃপক্ষের রয়েছে সীমাহীন উদাসিনতা। এ শিল্প নগরীর সকল মালিকদের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ নেয়া হলেও কোন সার্ভিস মালিকদের দেয়া হয়না। মালিকদেরকে নিজউদ্যোগেই সবকিছু করতে হয়। এ নিয়ে মালিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে।
শিল্প মালিকরা জানান, টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প নগরী গড়ে ওঠার সময় থেকে তারা এখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান করেছেন। প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পর থেকে এ শিল্প নগরীর তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। বিসিক কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় বিসিকের কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। সরকার তাদের কাছ থেকে সার্ভিস র্চাজ নিলেও তারা কোন সার্ভিস পাচ্ছেন না। এখানে ক্যামিক্যাল, ফুড, ইঞ্জিনিয়ারিং, পেপার মিলস, ফ্লাওয়ার মিলস, ওয়েস্টেজ পেপার, অ্যালুমিনিয়াম কিচেন ওয়ার, স্কয়ার বার, আক্সিজেন সহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু না আছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা- না আছে ভালো রাস্তা-ঘাট। তাদের এই বিসিক এরিয়ায় দৃশ্যত: কোন সিকিউরিটি নেই।
বিসিকে কর্মরত কয়েক নারী শ্রমিক জানান, রাতে তাদের কোন শিফট নেই। কিন্তু বিকালের শিফটে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় সন্ধ্যা হয়ে যায়। তখন বাড়ি ফিরতে অনেক সমস্যা হয়। বাইরের লোকজন এসে তাদেরকে নানা কথা বলে- তাদেরকে বিরক্ত করে। তারা বিসিক এলাকায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবি জানান। মালবাহী ট্রাক চালক লাল মিয়া, রহিম বক্স, হিরা মিয়া জানান, বিসিকের সব রাস্তাই খানাখন্দে ভরা। এখানকার রাস্তায় মাল বোঝাই ট্রাক নিয়ে যাওয়া যায় না। অনেক সময় গাড়ির এক্সএল ভেঙে যায়, চাকা পাঙচার হয়ে যায়, গাড়ির নানা সমস্যা দেখা দেয়। এতে তাদের অনেক লোকসান হয়।
সরেজমিনে এফএ ফুড প্রোডাক্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পাপন রহমান, এইচএফসি প্রোডাক্টসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. আব্দুস সালাম মিয়া, মেসার্স মুন মুন ফ্লাওয়ার মিলের প্রোপাইটর মো. রিয়াজ উদ্দিন জানান, বিসিকের রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। খানাখন্দে ভরপুর, প্রতিষ্ঠানের মালামাল আনা-নেয়ায় মারাত্মক সমস্যা হয়। এখানে বিশুদ্ধ পানির পরিবর্তে মাত্রারিক্ত আয়রনের পানি সাপ্লাই দেয়। ড্রেন আছে কিন্তু পানি নিষ্কাশন হয় না। বাইরের ছেলেরা এসে এখানে নেশা করে, কোন সিকিউরিটি নেই। এ নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। বিসিক কর্মকর্তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। শ্রমিকদের অনেক সমস্যায় থাকতে হয়। সমস্যা নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিসিকের বড় বড় কর্তাদের সাথে আলোচনা করা হয়েছে, কিন্তু সুফল মেলেনি। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ব্যক্তি জানান, এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রভাবে বিসিকের জয়গা দখল করে বাজার বসিয়েছে। অনেক দোকান পাট করেছে। তাদের কেউ কিছু বলতে পারে না। প্রশাসনের লোকজন এলেই তাদের ইশারায় এলাকাবাসী আন্দোলনে নামে। তখন কেউ আর এগিয়ে আসেনা। বিসিক শিল্প নগরীর কোন কোন মালিক নিজেদের স্বার্থে নানা অনিয়ম ও আগ্রাসী কর্মকান্ড করে। তাদের কারণে অন্য মালিকরা কোণঠাসা হয়ে থাকে।
টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মো. আবুল মনসুর জানান, বিসিকের জন্ম থেকে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনেক দৌঁড়-ঝাঁপ করে কয়েকটি রাস্তার কাজ করেছিলেন। তাছাড়া বিসিকে আর তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। তারা সরকারের কাছে বিসিক এর মালিকানা চেয়েছিলেন। তারা জমির দাম দিয়ে বিসিক কিনে তাদের মত করে উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন। সরকার তা করেনি। তাদের কাছ থেকে ঠিকই সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে কিন্তু সার্ভিস দিচ্ছেনা।
টাঙ্গাইল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ইকবাল হোসাইন জানান, তিনি ছাত্রাবস্থায় এখানে প্লট কিনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। বিসিক নগরী প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকার কোন উন্নয়নমূলক কাজ করেনি। বিসিক কর্মকর্তারাও কেমন একটা উদাসীনতায় ভুগছে। হোসাইন জানান, বিসিক শিল্প প্রতিষ্ঠান করার সময় যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল তা আজও সংষ্কার করা হয়নি। মালিকরা নিজেদের টাকায় শ্রমিক দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করেন। বিসিক এলাকার সব প্লট বরাদ্দ হলেও মালিকরা তা বুঝে পায়নি। স্থানীয় একটা চক্র বিসিকের জায়গা জবরদখল করে রেখেছে। এ নিয়েও কোন মাথা ব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশের প্রতিটি বিসিক নগরী একটি নির্ধারিত বেষ্ঠনির মধ্যে নিরাপত্তায় থাকলেও টাঙ্গাইলে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই।
তিনি জানান, বিসিকের মূল ফটকে কোন গেট নেই। সব মালিকরা মিলে নিজের অর্থে গেট নির্মাণ করছেন। তারা প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিসিক কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করেও কোন সুফল পাননি। টাঙ্গাইল বিসিকে উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় সরবরাহ করা হয়। টাঙ্গাইল শিল্প নগরী (বিসিক) কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম জানান, তিনি এখানে নতুন যোগদান করেছেন। বিসিক শিল্প নগরীর অনেক সমস্যা রয়েছে তা নিয়ে তিনি উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছেন। সেই সাথে আবেদনও করেছেন। খুব তাড়াতাড়ি সমস্যাগুলোর সমাধান হবে বলে তিনি আশা করেন। আর বিসিকের যে প্লটগুলো দখল হয়েছে তা দখলমুক্ত করার জন্য তিনি কাজ করছেন। এ বিষয়ে প্রশাসনের সাথেও কথা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।