করোনাকালে লকডাউনের মধ্যে যখন বন্ধ অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষালয়গুলো। সব শ্রেণি-পেশার নারী, কিশোরী ও তরুণীরা হয়ে পড়েছেন গৃহবন্দি। তখনও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই নেই তাদের। বরং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে তাদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা। ঘরে বসে অনলাইনে ব্যস্ত সময়ে তারা শিকার হচ্ছে সাইবার বুলিং তথা অনলাইনে যৌন হয়রানির। নারীর প্রতি বহুমাত্রিক সহিংসতা বন্ধ না হয়ে বরং যেন ধীরে ধীরে রেকর্ড ভঙ্গ করে চলেছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য মতে, দেশে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসে স্বামীর নির্যাতনে মারা গেছে ১৪৭ জন নারী, নির্যাতিত হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৯৪ জন, ধর্ষণের শিকার ৮১৩ নারী, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বলি ১৭১ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৩১ জনকে। ১৮৩ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়। ধর্ষণের শিকার ৮ জন নারী আত্মহত্যা করে। এই সময়ে যৌন হয়রানির শিকার ৮৩ জন এবং দুর্বৃত্তদের আক্রমণে ৬২ জন নারী আহত হয়েছে। এ বছরের সাত মাসে যৌতুকের জন্য ৮১ জন নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনে মৃত্যু ঘটেছে ৫০ জন নারীর।
আজ ঘরে-বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীরা প্রতিনিয়ত যৌন হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। এ থেকে বাদ যাচ্ছেন না প্রতিবন্ধীরাও। এমনকি বৃদ্ধ পুরুষদ্বারা ২২ মাসের শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার নজির রয়েছে। ৪-৫ বছরের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নারীও এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না।
২০১৭ সালে গণপরিবহনে চাঞ্চল্যকর রূপা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছিল সারা জাতি। আড়ালে-আবডালে নয়, ধর্ষক যখন লোকসম্মুখে নারীর প্রতি চরম নির্মমতা চালায়, তখন বুঝতে হয় এ সমাজে নারী কত অরক্ষিত। বিশেষকরে নিরীহ নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েও সর্বোচ্চ বিচার না পাওয়ায় ধর্ষক বারবার অপকর্মে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। আমাদের মতো রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থায় নারীরা সাধারণত লোকলজ্জা ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে সব ধর্ষণের কথা প্রকাশ করে না। মামলা করে হয়রানি ও সুষ্ঠু বিচার না পাওয়ার হতাশায় ধর্ষণের ঘটনাকে আড়াল করে যায়। মামলা নিতে পুলিশের গড়িমসি এবং মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অনেক ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার প্রচেষ্টার অভিযোগ রয়েছে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে।
২০১৯ সালের ২ আগস্ট রাতে যশোর থেকে কমিউটার ট্রেনে খুলনায় ফেরার পথে ফুলতলা রেলস্টেশনে নামলে কর্তব্যরত পুলিশ মোবাইল ফোন চুরির অপবাদে এক নারী যাত্রীকে আটক করে। পরে থানার ওসি, দারোগাসহ ৫ পুলিশ মিলে ওই নারীকে গণধর্ষণ চালায়। পরদিন ৫ বোতল ফেনসিডিল দিয়ে তাকে কোর্টে চালান দেওয়া হয়। আদালত গণধর্ষণের ঘটনা শোনার পর নারীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন করে গণধর্ষণ প্রমাণিত হয়।
ধর্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, উঠতি বয়সের কিশোর ও যুবক দ্বারাই নারী বেশি ধর্ষিত হয়, তবে ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিক কর্মী, মাদ্রাসার শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ধর্ষণের মতো এমন পাশবিকতা যে শুধু অশিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা কিন্তু নয়। কলেজ, ইউনিভার্সিটির মেয়েরাও সহপাঠী বা প্রেমিক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কলেজ, ইউনিভার্সিটি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী ধর্ষণের প্রমাণ মিলেছে। নিকটাত্মীয় দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে শিশু। নিম্নবিত্তের মানুষতাদের দারিদ্র্যজনিত হতাশায় অনেক সময় অপরাধপ্রবণ হয়ে ধর্ষণের মতো কাজে লিপ্ত হয়। বখে যাওয়া মাদকাসক্ত তরুণ-যুবকরা ভালোমন্দ জ্ঞানশূন্য হয়ে অবলীলাক্রমে ধর্ষণে লিপ্ত হতে দ্বিধাবোধ করে না। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারীকে মানুষহিসেবে গ্রহণ করতে না পারার মানসিকতা পুরুষের মাঝে যে মিথ্যে শ্রেষ্ঠত্ববোধের জন্ম দেয়, তা থেকে মূলত তাদেরকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের পথে ঠেলে দেয়।বাংলাদেশে ধর্ষণের জন্য যে আইনি বিধান রয়েছে তাতে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রমাণ করতে হয় যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আলামত সংগ্রহ এবং যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়। ধর্ষণের ব্যাপারে ধর্ষণের শিকার নারীকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদও পীড়াদায়ক। বিচার প্রক্রিয়ার বাধ্যবাধকতায় নারীকে বিপক্ষের কৌঁসুলির জেরার মুখে বারবার ধর্ষণ কারীর বিব্রতকর বর্ণনা দিতে হয়, এই অভিজ্ঞতা ধর্ষণের শিকার নারীর জন্য কঠিন আরেক শাস্তি। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিও ধর্ষণকে উৎসাহিত করে। কিংবা অপরাধী প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো অসাধু সদস্য তাদের না দেখার ভান করে।
ধর্ষণের মতো দুষ্টক্ষতকে সমাজ থেকে বিতাড়িত করতে হলে ধর্ষকের স্বরূপ উন্মোচিত করতে হবে। তরুণ সমাজকে মাদকের কবল থেকে ফেরাতে হবে। তরুণদের সুস্থ-সুন্দর মন ও মূল্যবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পরিবার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব নিতে হবে। ধর্ষিতা ও তার পরিবারকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আইনি সহায়তা দিতে হবে। নারী-পুরুষের স্বীকৃত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠাসহ রাস্তাঘাটে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলে ধর্ষণ প্রতিরোধ অনেকটা সহজ হবে। ধর্ষককে নিরপরাধ প্রমাণ করতে হলে ধর্ষণের শিকার নারীর ওপর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমবে। যেকোনো ধরনের ধর্ষণের বিচার চলাকালে ভিকটিমের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারীকে শুধু নারী নয়, একজন মানুষহিসেবে বিবেচনা করে জেন্ডারভিত্তিক এ সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে ধর্ষণ নির্মূলে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক প্রতিরোধ।
একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য লক্ষকরা যাচ্ছে। গত চার দশকে নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় ছাত্রীদের ভালো ফলাফল, নানা পেশায় তাদের অভাবনীয় দক্ষতা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মেধা-মননে, কায়িক শ্রমের কাজে কোথাও নারীসমাজ আর পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর সমান অধিকারের কথা বলা হলেও পারিবারিক আইনে নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্যের কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সুবিচার করা হচ্ছে না। শ্রমজীবী নারীর মজুরি বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা-লাঞ্ছনার রয়েছে এক কালো অধ্যায়। ধর্ষণ সামাজিকভাবে একটি ঘৃণিত কাজ। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি পাপ। দেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ দ-বিধির ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা ১০ বছরের ঊর্ধ্বে কারাদণ্ড বা তদ্রুপ অর্থদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে বা দলবেঁধে ধর্ষণের জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন-২০০০-এর ৯ ধারা অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বিদ্যমান এই আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে ১৩ অক্টোবর অধ্যাদেশ জারি হয়েছে। ফলে মন্ত্রিসভা কর্তৃক ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০০০’–এর অনুমোদিত আইন কার্যকর হলো। এর যথাযথ প্রয়োগ ধর্ষণসহ শিশু ও নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এটাই প্রত্যাশা আপামর জনগণের। তবে মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তি বাস্তবায়নে বিচারিক প্রক্রিয়া নারীবান্ধব হতে হবে।
সমাজ যদি পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতির ধারায় নিয়ন্ত্রিত হয় তবে সেটি একান্তই পুরুষের সমাজ। সেখানে নারী যে অধস্তন, সে তো পুরুষের যথেচ্ছ চাহিদা পূরণে বাধ্য। সর্বোপরি ধর্ষণসহ নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা রোধে সামাজিক কাঠামো বদলাতে হবে। নারী-পুরুষসমতার লক্ষ্যে আদর্শিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারে রাজনীতি, সমাজ বৈষম্যহীন সমতার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। দেশে অ্যাসিড সন্ত্রাস নির্মূলে ২০১৯ সালে যেমন সব স্তরে একযোগে বহুমাত্রিক কর্মোদ্যোগে সাফল্যের নজির রয়েছে তেমনি এবার ধর্ষণসহ সব নারী নির্যাতন রোধ করে নারীকে মর্যাদার আসনে বসাতে একই ধারায় সমাজ ও তারুণ্যের বিজয় সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।
[…] সর্বপ্রথম প্রকাশিত […]