গোলাম রাজ্জাক কাসেমী: ন্যায়ের পথে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়, মাজলুম ফিরে পায় নিজের অধিকার। সমাজ ও জগৎ সুরভিত হয় প্রশান্তির সুবাসে। অন্যথায় জীবন কাটে দুঃখে, নিরানন্দে। ন্যায়পরায়ণতা নবী-রাসুল ও নেককারদের চারিত্রিক ভূষণ। সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। তিনি ধনী-গরিব, ছোট-বড় সবাইকে মানুষ হিসেবে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। বিচারে কোনো ভেদাভেদ করতেন না। এমনকি শত্রু-মিত্রের মাঝেও কোনো পার্থক্য করতেন না। সবার ক্ষেত্রেই নবীজির সিদ্ধান্ত ছিল ন্যায়-ইনসাফে পূর্ণ। নবীজীবনের ন্যায়-ইনসাফের অনন্য কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।
নিজের সঙ্গে ইনসাফ
বদর যুদ্ধে ঘটনা। রাসুল (সা.) কাতারে সোজা করে সাহাবিদের দাঁড় করাচ্ছিলেন। হাতে তীর। হজরত সাওয়াদ (রা.) কাতার থেকে একটু সামনে এগিয়ে ছিলেন। রাসুল (সা.) পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কাতার সোজা করার জন্য তার পেটে আঘাত করে বললেন ‘হে সাওয়াদ! সোজা হও। হজরত সাওয়াদ বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে ব্যাথা দিলেন! অথচ আপনাকে প্রেরণ করা হয়েছে ইনসাফ কায়েম করার জন্য। আমি এর বদলা নিতে চাই। আমাকে কেসাস (বদলা) নেওয়ার সুযোগ দিন। রাসুল (সা.) ব্যথা দেওয়ার জন্য আঘাত করেননি। তবু তার এ কথায় রাগ করলেন না। ধমক দিলেন না। বললেন না যে, তাকে জেলবন্দি কর। আত্মঅহঙ্কারে জ্বলে উঠে বললেন না ‘কত বড় স্পর্ধা! চিন আমি কে? জান কার সঙ্গে কথা বলছ?’ বরং নিজেকে বিনীত করে সঁপে দিয়ে বললেন, ‘হে সাওয়াদ! কেসাস (বদলা) নাও।’
হজরত সাওয়াদ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি যখন আমাকে আঘাত করেছেন তখন আমার পেটের ওপর কাপড় ছিল না। রাসুল (সা.) তখন তার পেট থেকে কাপড় সরিয়ে দিয়ে বললেন, নাও, এবার কেসাস নাও। হজরত সাওয়াদ (রা.) তখন নবীজির পেট মোবারকে চুমু খেলেন। রাসুল (সা.) বলললেন, ‘কেন এমনটা করলে হে সাওয়াদ!’ সাহাবি জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা তো এখন জিহাদের ময়দানে, হয়তোবা এটাই আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। তাই চেয়েছি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু কাটুক আপনার শরীর মোবারকের সঙ্গে আমার শরীর স্পর্শ করে! (বদলা নেওয়া আমার উদ্দেশ্য না)। রাসুল (সা.) তখন তার জন্য নেক দোয়া করলেন। (মারেফাতুস সাহাবা : ১০/৭১)
আরেকবার রাসুলুল্লাহ (সা.) সম্পদ বন্টনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এক ব্যক্তি এসে তার ওপর ঝুঁকে পড়ল। রাসুল (সা.) তাকে খেজুরের লাঠি দিয়ে দূরে সরাতে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষতভাবে চোট লেগে চেহারায় দাগ পড়ে যায়। ইনসাফের নবী (সা.) তখন তাকে বললেন, ‘এস আমার থেকে এর বদলা নাও।’ সাহাবি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! বরং আমি ক্ষমা করে দিলাম। (আবু দাউদ : ৪৫৩৬)
নিজেকে প্রাধান্য না দেওয়া
রাসুল (সা.) অধিকারের ক্ষেত্রে নিজেকে অন্যের ওপর প্রাধান্য দিতেন না। নিজে আরাম-আয়েশ করে অন্যের ওপর কষ্ট চাপিয়ে দিতেন না। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বদরের দিন প্রত্যেক তিনজনের ভাগে একটি করে বাহনের উট ছিল। রাসুল (সা.)-এর সঙ্গীদ্বয় ছিলেন হজরত আলী ও আবু লুবাবা (রা.)। যখনই রাসুল (সা.)-এর হেঁটে চলার পালা আসত তখন তারা বলত, আপনি বরং আরোহণ করুন আমরাই আপনার পরিবর্তে হাঁটব। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী নও এবং আমিও তোমাদের চেয়ে প্রতিদান লাভের কম মুখাপেক্ষী নই।’ (মুসনাদে আহমদ : ৩৯০১)
পারিবারিক জীবনে ইনসাফ
রাষ্ট্র ও যুদ্ধ পরিচালনায় ব্যস্ততার অজুহাতে রাসুল (সা.) পরিবার ও স্ত্রীদের অধিকার আদায়ে কখনও অবহেলা করতেন না। বরং এ ক্ষেত্রেও পূর্ণ ইনসাফের পরিচয় দিতেন। হজরত আয়শা (রা.) বলেন, নবী (সা.) তার স্ত্রীদের মাঝে খুবই ন্যায়সঙ্গতভাবে রাত্রিযাপনের পালা বন্টন করতেন আর বলতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার সামর্থ্য অনুযায়ী এই আমার পালা বন্টন। যে বিষয়ে শুধু তোমারই পূর্ণ সামর্থ্য আছে, আমার কোনো সামর্থ্য নেই। এ ব্যাপারে আমাকে তিরস্কার কর না।’ (তিরমিজি : ১১৪০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) সফরের মনস্থ করলে স্ত্রীদের মধ্যে লটারি করতেন। যার নাম আসত তিনি তাকে নিয়েই সফরে বের হতেন। এ ছাড়া প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য একদিন একরাত নির্দিষ্ট করে দিতেন। (বুখারি : ২৫৯৩)। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর একজন স্ত্রী তাকে একটি বাটিতে কিছু খাবার পাঠান। হজরত আয়শা (রা.) নিজের হাত দিয়ে বাটিতে আঘাত করে খাবারগুলো ফেলে দেন, ফলে বাটিও ভেঙে যায়। নবী (সা.) বললেন, খাবারের জন্য খাবার এবং বাটির জন্য একটি বাটি প্রদান করতে হবে। (তিরমিজি : ১৩৫৯)