প্রতারণা আজ সমাজের আতঙ্ক। সমাজে বসবাসের ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন সম্পর্ক তৈরি হয় যার ভিত্তি হলো বিশ্বাস করা। প্রতারণার ফলে মানুষ মানুষে বিশাস হারিয়ে যায়। যার ফল পরোক্ষভাবে সমাজের ওপরে এসে পড়ে। সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ মানুষের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট করে বলে প্রতারণাকে সামাজিক নতুন ভাইরাস বলা উচিত। প্রতারণা হচ্ছে অসদুপায় অবলম্বন করে কোনো কিছু সমাধানের সক্ষমতার কারণে পুরস্কার গ্রহণ করা। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় প্রতারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। আসলে প্রতারণার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া খুব কঠিন। কারণ প্রতিনিয়ত প্রতারকরা নতুন নতুন উপায় মানুষকে প্রতারিত করছে। প্রতারণার ইতিহাস যদি দেখা যায় তবে সেটার হদিস পাওয়া যাবে না কারণ এটি অত্যন্ত প্রাচীনকালের অপরাধগুলোর মধ্যে একটি। প্রতারকরা সুকৌশলে প্রতারণা করে থাকে। মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময়ে ছোটখাটো হলেও প্রতারিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে একটি হলো প্রেম-ভালোবাসাজনিত বিষয়ে।
কিছু কিছু প্রতারণায় মানুষ আইনি প্রতিকার আশা করে না বা চায় না কারণ, বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু যদি সমাজের বড় বড় অপরাধের দিকে তাকানো হয় তবে দেখা যায় যে ছোট থেকে বড় অনেক ধরনের প্রতারণা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতারক চক্রকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হতে দেখা যায়। কিন্তু তবুও নির্মূল হয় না। কিছুদিন পূর্বে কিছু বিদেশি শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার হতে দেখা যায়। যারা বাংলাদেশি এক নারীকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। তারা ফেসবুক ব্যবহার করে বিভিন্ন বৈদেশিক উপহারসামগ্রীর কথা বলে মানুষের কাছে থেকে অর্থ আদায় করত। যার কোনো ভিত্তিই ছিল না।
আবার করোনা মহামারিতে সরকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা রোগী শনাক্তের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অনুমোদন দেয়। তার মধ্যে কিছু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষা ছাড়াই ফলাফল দিয়েছে। এটাই প্রতারণা ছিল। আবার এমনও প্রতারক আছে যারা ভিন্ন উপায়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতারণা করে থাকে। বর্তমানে দেখা যায় যে, প্রতারকরা রাজনৈতিক সখ্যতা ব্যবহার করে প্রতারণা করে থাকে। যেমন সুযোগ নিয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে ছবি তোলা, সখ্যতা করা, দালাল তৈরি করা, সিন্ডিকেট করা ইত্যাদি। এগুলো দিয়ে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে প্রতারণা করে থাকে। প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে মানুষ পাচার করা হয়।
প্রতারণা করা বরাবরই আইনত অপরাধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা অনুযায়ী যার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং সঙ্গে অর্থদণ্ডও দিতে পারে। আবার যারা এর সঙ্গে জড়িত থাকে কিংবা সহায়তা করে তারাও দণ্ডবিধির ৩৪, ৩৫, ১০৭ ও ১০৮ ধারা অনুযায়ী সমান অপরাধী ও সমান দণ্ড পাবে।
বর্তমানে প্রতারণার ক্ষেত্র এতটা ব্যাপক যে, ওই আইনগুলো অপরাধের শাস্তি হিসেবে যথেষ্ট নয়। আবার আলাদা প্রতারণার ধরন ভেদে আলাদা আইন ও মামলা-মোকদ্দমা হয়। যেমন চেক জালিয়াতি, দলিল জালিয়াতি অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি। আবার ক্ষতিপূরণের দাবিতে দেওয়ানি মামলা করা যায়। এসব মামলাতে প্রতারণা প্রমাণ করাই কষ্টকর কাজ। আবার যেমন সমাজে কিছু সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র আছে, যারা মেয়েদের ব্যবহার করে ছেলেদের সঙ্গে বিয়ে সম্পাদন করে। পরবর্তীতে নারী নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে মোহরানা আদায় করে তালাক দিয়ে দেয়। এ জাতীয় কিছু সিন্ডিকেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা খেলেও অনেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া যায় না।
প্রতারণা হতে বাঁচতে হলে সচেতনতার বিকল্প নেই। কোনো ব্যবসা কিংবা লেনদেনে গেলে আইনসম্মত উপায়ে চুক্তি করে নিতে হবে। কারণ প্রতারকদের প্রধান লক্ষ্য থাকে অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করা। কোনো বিষয়ে লিখিত প্রমাণ ও সাক্ষী থাকলে খুব সহজে প্রমাণ করা যায়। রাস্তায় চলাকালীন অবস্থায় অন্যকে কোনো প্রকার সুযোগ দেওয়া কিংবা বিশ্বাস করা যাবে না। বিভিন্ন জায়গায় অবস্থানকালে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের খোঁজ রাখতে হবে। প্রতারিত হলে যত দ্রুত সম্ভব থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে হবে। প্রতারকরা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সুকৌশলে কাজে করে। তার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে আইনি প্রতিকার নিতে হবে। প্রতারক চক্রকে নিয়ে আরও আইন প্রণয়ন করা প্রয়োজন এবং সব ধরনের প্রতারণাকে সুনির্দিষ্ট চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকার উদ্যোগ ও জনগণকে সরকারের পাশে থাকতে হবে। সবশেষে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে, সবসময় নিজেকে নিরাপদ অবস্থানে রাখতে হবে কারণ অপরাধের প্রতিকারের থেকে প্রতিরোধ উত্তম।
[…] সর্বপ্রথম প্রকাশিত […]