এম সাইফুল ইসলাম শাফলু: ১৯৭১ সালের যুদ্ধদিনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিন-রাত সেবা করেছেন। তাঁদের মনে জুগিয়েছেন সাহস। শরনার্থী ক্যাম্পে অসহায় মানুষকে নানাভাবে সেবাসহ খবর বার্তা আদান-প্রদান করেছেন। কিন্তু তাঁর এ অবদানের কথা কোথাও উল্লেখ নেই। তিনি সে সময়ে মুক্তিকামী মানুষের খবর রাখলেও জীবনের শেষ বয়সে এসে তার খবর এখন আর কেউ রাখেনি। এমনকি নামটি পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ওঠেনি। অনেকের কাছে গেছেন, কোনো ফল হয়নি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এখন ইয়াকুব আলীর (৬৮) চাওয়া একটাই, শুধু মরার আগে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নিজের নামটি দেখে যেতে চান তিনি।
ইয়াকুব আলীর বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার বহেড়াতৈল ইউনিয়নের আমতৈল গ্রামে। সরেজমিনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, বহেড়াতৈল ক্যাম্পে ১৯৭১ সালের ২৫ মে আবদুল গফুর কোম্পানীর অধীনে ভর্তি হয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর ১১ নম্বর সেক্টরে ১ নম্বর হাতেম আলী কোম্পানীতে বিভিন্ন রনাঙ্গণে সক্রিয় যুদ্ধে অংশ নেন। পরবর্তীতে ৩ নম্বর কোম্পানী কমান্ডার আবদুস ছবুর মিয়ার সঙ্গে যোগ দেন। এ সময় তিনি কমান্ডারদের নির্দেশ পালনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাযত্ন, ক্যাম্পে ক্যাম্পে খবর-বার্তা আদান-প্রদান, গোলাবারুদ পাহারা দেওয়া এবং খাবার সরবরাহ করতেন। ইয়াকুব আলী লেখাপড়া তেমন জানেন না। তিনি এ প্রতিনিধির কাছে যুদ্ধ ও পরবর্তী কালীন সময়ের তার নামের বিভিন্ন কাগজপত্র দেখান। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেট আছে। এছাড়াও টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের স্বাক্ষরিত সার্টিফিকেটও রয়েছে তাঁর নামে। অথচ তিনি এখনো মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সরকারি নানা সুবিধাতো দূরের কথা; জীবন সায়াহ্নে এসেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাতেই নাম ওঠাতে পারেনি! ইয়াকুব আলীর আক্ষেপ গরীব মানুষ বলেই আমার নাম ওঠেনি। ট্যাহা (টাকা) পয়সা খরচ করতে পারিনা…। ততক্ষণে যুগলচোখের কোণে অশ্রু জমেছে। অশ্রু গদগদ কণ্ঠে বলেন, আমি অসুখ (অসুস্থ) ডাক্তার দেহাতে (দেখাতে) পারিনা। আরও কত অভাবের কথা যে ভিড় ভিড় করে বললেন-তার ইয়ত্তা নেই। নানা রোগশোকে আক্রান্ত ইয়াকুব আলী এখন আর তেমন চলাফেরাও করতে পারেন না। পরিবার নিয়ে নিদারুন কষ্টে চলছে তার যাপিত জীবন। তিনি বছর খানেক আগে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এখনো আপনার নাম তালিকায় ওঠেনি; তাকে দেখে এমন মন্তব্য বঙ্গবীরের ছিল বলে জানালেন ইয়াকুব আলী। ইয়াকুব আলী জানান, ঢাকা, টাঙ্গাইল ও সখীপুর উপজেলার অনেক মুক্তিযোদ্ধার কাছেও গেছেন। কিন্তু তালিকায় আর নাম ওঠেনি।
তালিকায় নাম তোলার জন্য সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। এ আবেদনেও কোনো সাড়া পাননি।
ইয়াকুব আলী আরো বলেন, ‘অভাব-অনটনে দিন যাচ্ছে। টাকা-পয়সা চাই না। এখন শুনছি সরকার আবার তালিকা করতাছে। দেশের জন্যে এত কিছু করলাম। শুধু মরার আগে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নামটা দেখে মরতে চাই।’
ওই এলাকার এবং সে সময়ের তার সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলী, আফাজ উদ্দিন, মো. খছরু মিয়া, মতিয়ার রহমান ও ছাদেকুর রহমান বলেন, ইয়াকুব আলী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের সঙ্গেই তিনি যুদ্ধ করেছেন। কি কারণে এখনো তাঁর নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি আমাদের জানা নেই। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করে রাষ্ট্রীয় সম্মান দেওয়া উচিৎ।
সখীপুর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড সংসদের সাবেক কমান্ডার এম ও গণি বলেন, ইয়াকুব আলী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তবে কেন তাঁর নাম তালিকায় ওঠানো হয়নি তা তিনি জানেন না বলে জানান।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।