নিজস্ব প্রতিনিধি: শেষ সময়েও ক্রেতা শূণ্য হয়ে পড়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ীর হাট গুলো। সদর উপজেলার করটিয়া, বাজিতপুর, কালিহাতী উপজেলার বল্লা ও যোকেরচর শাড়ীর হাট গুলোতে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। যার ফলে অবিক্রিত শাড়ী নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা। সপ্তাহে এসব হাট গুলো থেকে প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার শাড়ী কাপড় বিক্রি হয়। আশানরুপ বেঁচা-কেনা না হওয়ায় অনেকেই এবার ঈদুল আযাহাতে কোরবানি দিতেও পারবেনা বলে জানা গেছে। অন্যদিকে টাঙ্গাইলের এই বৃহৎ শিল্পকে বাচাঁতে সরকারের কাছে নানা দাবি জানিয়েছেন তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি গুলো হচ্ছে- সুতার দাম কমিয়ে আনা, ভারতীয় শাড়ী আমদানি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, সহজ শর্তে ও বিনা সুদে ব্যাংক ঋন দেয়া, ঈদ মৌসুমে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, শাড়ী ব্যবহারের প্রতি নারীদের উৎসাহ বাড়াতে প্রচার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া, শাড়ী রপ্তানিতে নতুন বাজার তৈরি করা, সরকারি অফিস গুলোতে নারীদের শাড়ী পড়া বাধ্যতা মুলক করা, তাঁতিদের সসম্যা সমাধানে তাদের নিয়ে মাসিক আলোচনা সভা করা। এসব দাবি বাস্তবায়নের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
সরজমিনে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন তাঁত শিল্প এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে তাঁতের সেই পুরোন খটখটি শব্দ নেই। গ্রামঞ্চলের নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা তাঁত বিক্রি করে দিয়ে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছে। এখনও যারা টিকে আছে তারা দাদনে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তাঁত শিল্প চলে গেছে বিত্তবানদের দখলে। একাধিক তাঁত মালিকের অভিযোগ, উচ্চমূল্যে সুতা ক্রয়, শ্রমিক মজুরি, রং, প্যাকিং, বিদ্যুৎ বিল সহ পরিবহন খরচ মিলিয়ে একটি কাপড় তৈরি করে বাজারে ন্যায্য মুল্য পাওয়া যাচ্ছেনা। শাড়ীর ব্যবসা শুধু মাত্র ঈদ ও পুজা নির্ভর হওয়ায় বছরের বাকিটা সময় তাঁতিদের সংসার চালানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকারের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত বৃহৎ জনগোষ্ঠির এই শিল্পটি।
তাঁত মালিক মমিনুর রহমান জানান, নিম্নমানের ও সস্তা দামের ভারতীয় চাকচিক্যপূর্ন শাড়ী গুলো দেশীয় বাজারে প্রবেশ করায় আমাদের অনেক ভালো মানের শাড়ী মার খাচ্ছে। গত দুই যুগ ধরে বেড়েই চলেছে সুতার দাম। সুতার দাম কমাতে সরকারের কোন পদক্ষেপ নেই। পাওয়ারলোম মেশিনে চাহিদার চেয়েও বেশি শাড়ী উৎপাদন হচ্ছে। অন্যদিকে নারীরা এখন তাদের দেশীয় বাঙ্গালিয়ানা হারিয়ে থ্রীপিসসহ নানা আধুনিক পোশাক পরছে। নারীদের শাড়ী ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে সরকারের উৎসাহ মুলক কোন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছেনা। যার ফলে নানা কারনেই আমাদের শাড়ী ব্যবসা মুলত ঈদ নির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশীয় বাজারে ভারতীয় শাড়ী প্রবেশ বন্ধ করতে না পারলে এবং তৃণমুল তাঁতিদের সমস্যা নিয়ে সরকার আলোচনায় না বসলে এক সময় বৃহৎ এই তাঁত শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বে।
ব্যবসায়ী ফরিদ বিন মুসলিম জানান, বিএনপি ও আওয়ামীলীগ সরকার তাঁত শিল্পের উন্নয়নে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁতিদের সাথে তাঁত বোর্ড বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন কর্মকর্তা বা সরকারের কোন তরফের আলোচনা হয়েছে বলে আমার জানা নেইা। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের তাঁত শিল্পকে “টাঙ্গাইল জেলার ব্যান্ডিং” ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তৃণমুলের তাঁতি ও ব্যবসায়ীদের এতে কোন সুবিধে হয়েছে কিনা জানা নেই। তাঁত শিল্প চলে গেছে বিত্তবানদের হাতে। স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋন পাচ্ছেনা ব্যবসায়ীরা। আর ব্যাংক ঋন পেতে গেলেও রয়েছে কাগজ পত্রাদির নানান জটিলতা। গত এক যুগে নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের হাজার হাজার তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারকে তাঁতিদের সমস্যা সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এই ব্যবসায়ী।
এ ব্যাপারে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ের বেসিক সেন্টার টাঙ্গাইল জেলা লিয়াজো অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, বর্তমানে পূর্বের তুলনায় তাঁত ও তাঁতিদের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গত বছর নভেম্বরে পাথরাইলে এক আলোচনা সভায় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রনালয়ের সচিব ফয়জুর রহমান পাথরাইলে একটি তাঁতপল্লী করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছন। টাঙ্গাইল সেন্টারের অধিনে ৬ টি উপজেলা রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় সমিতি ওয়্যারি সুতার উপর ৫ শতাংশের উপরে যে ইমপোর্ট ট্যাক্স আছে তাঁত বোর্ডের প্রস্তাবে ও তাঁতিদের সুবিধার্থে সরকার তা মওকুফ করে দিয়েছে। ব্যবসা চালিয়ে নেয়ার জন্য ১৯৯৯ সালের আইনে তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে প্রান্তিক তাঁতিদের সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বর্তমান সময় অনুপাতে সরকারের এ ঋন যথাপযুক্ত নয় এবং এ আইনের পরিবর্তন করারও দরকার বলেও অনেকের অভিমত।
এরপরও সব কিছু ছাপিয়ে ঈদ ও পুজাকে কেন্দ্র করে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ধুলটিয়া,বাজিতপুর, সুরুজ, বার্থা, বামনকুশিয়া, গোসাইজোয়াইর, তারটিয়া, এনায়েতপুর, বেলতা, গড়াসিন, সন্তোষ, কাগমারী প্রভৃতি ও দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলুয়া, দেওজান, নলশোঁধা, বিষ্ণুপুর, মঙ্গলহোড়, কালিহাতী উপজেলার বল্লা রামপুর, ছাত্তিহাটি, আইসরা, রতনগঞ্জ কোবডোরা প্রভৃতি গ্রামে তৈরি হচ্ছে মনোমুগ্ধকর রুচি সম্মত টাঙ্গাইল শাড়ী। এবারের ঈদ ও পুজার আকর্ষন হচ্ছে, হাইব্রিট, সুতি ও সিল্ক জামদানি, বালুচুরি, ধানসিঁড়ি, আনারকলি, গ্যাস, ডেঙ্গু, শপসিল্ক, রেশম, তশর, ফোরফ্লাই, কাতান, শাপাইরা, একতারি দোতারি, মনপুরা, সুতি কুচি ইত্যাদি। জেলার তৃণমুলের তাঁত মালিক ব্যবাসীদের দাবি পূরণে ও তাঁত শিল্পকে বাঁচাতে সরকার কোন কার্যকরি পদক্ষেপ নেয় কিনা সেটিই এখন দেখার বিষয়।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।