মঙ্গলবার, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৪
Homeজাতীয়সখীপুরে অবৈধ করাত কলে উজার হচ্ছে বন, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ

সখীপুরে অবৈধ করাত কলে উজার হচ্ছে বন, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ

 

এম সাইফুল ইসলাম শাফলু :
সখীপুরে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে ৫৬টি অবৈধ করাত কল গড়ে ওঠেছে। ওইসব করাত কলে দিনরাত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ ও শাল-গজারি কাঠ চেরাই করে দেদারসে পাচার করা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করাত কলগুলো না থাকলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নেতা কর্মীরা নামে বেনামে ওইসব অবৈধ করাতকল স্থাপন করেছেন। স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ৫৬টি অবৈধ করাতকলের (লাইসেন্সবিহীন) মধ্যে বহেড়াতৈল রেঞ্জে ২৬টি, হাতিয়ায় ১৭টি , বাঁশতৈল রেঞ্জে সাতটি ও পৌরসভায় ছয়টি করাতকল রয়েছে। বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তা কর্মচারীরা এমনকি কিছু আসাধু সাংবাদিক নামধারীরাও নিয়মিত টাকা পাচ্ছেন ওই সব করাত কল গুলো থেকে এমন অভিযোগ রয়েছে অহরহ। এতে প্রতিমাসে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের প্রায় এক কোটি টাকা মূল্যের চেরাই কাঠ পাচার হচ্ছে। ফলে উজার হচ্ছে সংরক্ষিত বন, বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি আর হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। এসব করাত কলের বেশির ভাগই সংরক্ষিত শাল-গজারি ও সামাজিক বনায়নের ভেতর, বন ঘেঁষে এমনকি বন কর্মকর্তাদের কার্যালয়ের কাছেই স্থাপন করা হয়েছে।
পৌরসভার বৈধ করাতকল মালিকদের অভিযোগ, পৌরসভায় বৈধভাবে (লাইসেন্সকৃত) ৩৫টি করাতকল থাকলেও অবৈধ করাতকলগুলোর দাপটে বৈধ করাতকল চলছে না। তারা অভিযোগ করেন, বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপনের সরকারি বিধান না থাকলেও স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজসে ওইসব করাতকল বনাঞ্চলে ভেতরেই গড়ে তুলা হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, হাতিয়া রেঞ্জ কার্যালয়ের ৩০০-৪০০ গজের মধ্যে দেলোয়ার হোসেন, আবুবকর, শাহীন আল মামুন ও আবু সাঈদের চারটি করাতকল, কালিদাস বিট কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মাত্র ১০০ গজের মধ্যে মকবুল হোসেন ও আবদুর রাজ্জাক যৌথ মালিকানায় একটি এবং ফরিদ হোসেন আরেকটি করাতকল স্থাপন করেছেন।
এছাড়াও কালিদাস বিটের ধুমখালী এলাকায় সামাজিক বনায়ন ঘেঁষে আবদুস সবুর চালাচ্ছেন আরেকটি করাতকল। একই বিটের করটিয়াপাড়া চতলবাইদ গ্রামে নঈম উদ্দিনের, মিণ্টু মিয়ার ও মজনু মিয়ার বন ঘেঁষা একটি করে তিনটি করাতকল দেদারছে চালাচ্ছেন।
কাঁকড়াজান বিট বহেড়াতৈল রেঞ্জের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওই বিটের খুবই কাছে পশ্চিম পাশে জয়নাল অবেদিনের ও উত্তর পাশে নূর জামাল করাতকল স্থাপন করেছেন। ওই দুই করাতকলেই গজারি ও সামাজিক বনায়নের আকাশমনি গাছের ছড়াছড়ি দেখা যায়। নূর জামাল করাতকলের বিরুদ্ধে পত্রিকায় না লিখতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘বন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ঠদের ম্যানেজ করেই আমরা এসব কল চালাই।
বহেড়াতৈল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরজ্জামান মঞ্জু বলেন, ১০ বছর আগেও এ এলাকায় কত গজারি গাছ ছিল। সন্ধ্যে হলেই শেয়ালের হাঁক-ডাক শোনা যেত। এখন বনের ভেতর অবৈধ করাতকল গড়ে উঠায় দিন দিন শাল-গজারি বিলীন হয়ে যাচ্ছে আর পশু-পাখির শব্দও কমে গেছে।
বন কার্যালয়ের পাশে করাতকল কীভাবে চলছে- জানতে চাইলে বহেড়াতৈল রেঞ্জের কর্মকর্তা আতাউল মজিদ করাতকল মালিকদের কাছ থেকে মাসওয়াহারা নেওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, এ মাসের শুরতেই ওইসব অবৈধ করাতকল উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে অভিযান চালানো হবে।
সখীপুর পৌরসভার বৈধ করাতকল মালিক সমিতির সভাপতি মো. জিন্নত আলী মিয়া বলেন, ‘অবৈধ করাতকলগুলোতে স্থানীয় বন বিভাগের লোকজনকে ম্যানেজ করে চালানো হচ্ছে। এসব কলে দিন-রাত সামাজিক বনায়ন ও শাল-গজারি গাছ চেরাই পাচার করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি করাতকল মালিকের নাম জানা গেলেও, বৈধ কাগজপত্র ও লাইসেন্স না থাকায় কোন্ করাতকলের কে প্রকৃত মালিক তা কেউ স্বীকার করতে চায় না। তবে অবৈধ করাতকল মালিকদের নিয়ে উপজেলায় একটি সমিতিও রয়েছে। এ সমিতিতে উপজেলার গড়বাড়ি গ্রামে সামাজিক বনের পাশে স্থাপিত কল মালিক আবুল কাশেম সভাপতি পদে ও উপজেলার সাপিয়াচালাগ্রামে স্থাপিত করাতকলের মালিক কামরুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক পদে রয়েছেন।
ওই দুই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বৈধকরাতকল মালিকদের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা কোনো অবৈধ কাঠ চেরাই না। শুধু সরকারের কাছ থেকে নিলামে ক্রয় করা গাছগুলো মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্য চেরাই করে থাকি। তবে বনের কাছে থাকায় আমাদের কলগুলোর বিধি মোতাবেক লাইসেন্স দিচ্ছে না।
সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক রহিজ উদ্দিন বলেন, ‘বন ঘেঁষে অবৈধ এসব করাতকলে অবাধে বনাঞ্চলের গাছ চেরানো হলে সখীপুরে বন ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না।
টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মাসুদ রানা বলেন, ‘সংশোধিত বন আইনেও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে করাতকল স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিগগিরই ওইসব অবৈধ করাতকলগুলো উচ্ছেদে অভিযান চালানো হবে।’

নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

- Advertisement -
- Advertisement -