মহামারি করোনা মোকাবিলায় গ্রিন, ইয়েলো নয় হাজারে মৃত্যু ছুঁয়ে সরাসরি রেড জোনে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। আজ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের সংখ্যা ৭৫ হাজার এবং মৃত্যু হয়েছেে এক হাজারের ওপরে মানুষ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। অথচ সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও সমন্বয় থাকলে সরকারি-বেসরকারি সম্মিলিত কার্যক্রমের মাধ্যমে চীন, ইটালি, স্পেন, আমেরিকা থেকে শিক্ষা নিয়ে গ্রিন জোনেই থাকতে পারতাম আমরা। আজ সাধারণ রোগীকে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় মরতে হতো না। সচল রাখা যেত কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা। অদ্ভুত আঁধার আজ মানব জাতিকে ঘিরে ধরেছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কাছে পরাজিত হতে চলেছে মানব জাতির সব আস্ফালন ও অর্জন।
ভাবতে কষ্ট হয় কত অসহায় হলে শ্রেষ্ঠ জীব দাবি করা মানুষেরা শুধু সংখ্যায় পরিণত হয়! পিতা-মাতার মৃত্যুর কারণ হয় সন্তান। নিজের অজান্তে মৃত্যুকে ফেরি করে চলেছে এক স্বজন থেকে আরেক স্বজন! কেউ কেউ আবার আক্রান্ত হতে পারে জেনেও অনান্য মানুষের ঘাতক হয়ে উঠছে। অবহেলা ও উদাসীনতায় ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি। উদাসীনতা ও অবহেলার মাত্রা অতিক্রম করে মানুষের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে করণীয় ঠিক করছে উন্নত বিশ্বের কোনো কোনো রাষ্ট্র। তারা কেনইবা এমন করছে তার কারণও আমাদের অজানা নয়। সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও জীবনবোধকে ভুলে ক্ষমতালোভী কিছু মানুষের কারণে আধুনিক পৃথিবী আজ চরম সঙ্কটের মুখোমুখি। অথচ যে মহৎ মানুষগুলোর অন্তরে মানুষকে ভালোবাসা তথা দেশপ্রেমের এক সহজাত অনুভব, উজ্জ্বল আলোর মতো জেগে আছে তারা আজ অবহেলিত, উপেক্ষিত।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ৩ মাস অতিক্রম করেছে। ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আমাদের স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু বিগত তিন মাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার চিত্র সবখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ যে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা এই সংক্রমণের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না, অথবা তারা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল তা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হয়তো বিজ্ঞানকে ভুলে তারা এই ভাইরাস অবিশ্বাসীদের হয়, এই ভাইরাস এত এত তাপমাত্রায় ছড়ায় না, এ রকম নানা রঙের তত্তে¡ বিশ্বাস করেছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে যে চরম উদাসীনতা ও অপরাধ করেছে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ভেবেছিলাম তার শাস্তি নিশ্চিত হবে। কিন্তু দৃশ্যত এর কিছুই দেখা যায়নি। বরং ব্যর্থদের কারও কারও পদোন্নতিও হয়েছে। করোনা দুর্যোগের শুরু থেকেই কোথাও কোথাও অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির যে চিত্রর দেখা মিলছে, তা সুস্থ সমাজের চিত্র নয়।
শুরু থেকেই যারা করোনা দুর্যোগ নিয়ে লিখেছে, সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ সেসব কথা পাত্তাই দেয়নি বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন বলতে শুরু করে, টেস্ট টেস্ট এবং টেস্ট তাদের এই কথাকেও আমলে নেয়নি সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তারা মিডিয়ার সামনে দিনের পর দিন বলেছে, ‘আমরা প্রস্তুত’। কেউ কেউ আবার একধাপ এগিয়ে বলতে চাইল বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের চেয়েও আমাদের প্রস্তুতি ভালো। তাহলে তাদের এই মিথ্যাচার ও ধৃষ্টতা কি শুধু জবাবদিহিতাহীন রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক লুটপাটের রাজত্ব না গভীর ষড়যন্ত্র! ষড়যন্ত্র কেন বলছি তা বলতে চাই, আমরা বিগত সময়ে দেখেছি ঘরে-বাইরের ষড়যন্ত্র, দেখেছি আজীবন লড়াকু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সব অর্জন ও কর্মপ্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মরিয়া একটি সুবিধাভোগী মহল। তারা দেশের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রীকে এক প্রকার জিম্মি করে ব্যবসার নামে লুটপাট করতে চেয়েছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। করোনাকে সামনে রেখে মাস্ক, পিপিই, গ্লাভস, গগজ, টেস্ট কিট ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনাকাটার যে দুর্নীতি ও লুটপাটের ধান্দায় ব্যস্ত সেই মহল। সরকারের সব সংস্থা জেনেও না জানার ভান করে আছে, কিন্তু কেন ? সরকার প্রধান শেখ হাসিনাকে বিব্রত করাই কি তাদের প্রধান লক্ষ্য নাকি পুরো দেশটাকেই পৃথিবী থেকে আইসোলেটেড করতে চায় তারা ?
সারা দেশে কত হাসপাতাল আছে, কোন কোন জেলায় সংক্রমণ বেশি বা কম, কোভিড ও নন-কোভিড চিকিৎসার ধরন কী হবে, জীবন ও জীবিকা কীভাবে চলবে সেই ভাবনা স্বাস্থ্য বিভাগ সঠিকভাবে চিন্তা করেনি। এখনও স্বাস্থ্য বিভাগের প্রকৃত তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার অনেক গরমিল রয়েছে এমন অভিযোগও বিস্তর। মহামারি নিয়ে সরকারের সংস্থার কাছ থেকে তথ্যে লুকোচুরি বা বিকৃতি ভীষণ দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক।
মহামারি বিশেষজ্ঞদের মতে প্রথম থেকে যদি সর্বোচ্চ পর্যায়ে টেস্টের ব্যবস্থা করা যেত, আক্রান্তদের বাছাই করা যেত এবং দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করে সঠিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় সেবা দিতে পারলে আক্রান্ত রোগী আজ ৭৫ হাজার ছাড়াত না। বিশেষজ্ঞ অনেকের প্রশ্ন এখন ৫২টি ল্যাবে পরীক্ষা করছেন, এটা আগে করলেন না কেন ? তিন মাস সময় পেলেন, ৬৪ জেলায় ৬৪টি ল্যাব বসালেন না কেন ? দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার মেশিন ছিল, এগুলো কাজে লাগালেন না কেন ?
আমরা দেখলাম জাতির এই ক্রান্তিকালে একেকটি মেশিন (আরটিপিসিআর) তিন গুণ দামে কেনা হয়েছে। আবার ২০২০ সালে এসে ২০০৯ সালের মেশিন কিনছেন। এই পুরনো মডেলের মেশিনে ভালো ফল পাচ্ছে না। তখন যদি আধুনিক মেশিন কেনা হতো, কম দামেই কেনা যেত। আবার চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময়ও পাওয়া যেত।এই মহাদুর্যোগে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতা নয় সরকারের ত্রাণ ব্যবস্থাপনাসহ কয়েকটি সেক্টরে হ-য-ব-র-ল চিত্র ফুটে উঠেছে। মহামারিকে তুচ্ছ ভেবে ইচ্ছেমত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বারবার পরিবর্তন করেছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে। কখনও শ্রমিকদের ঢাকায় ডেকে আনা হলো, আবার কখনও বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বিদেশফেরতদের নিয়েও শুরু থেকে নাটকীয় সব ঘটনা ঘটেছে। যখনই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করেছেন, তখন পরিস্থিতি একটু বদলেছে। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। এক কথায় দারুণভাবে সারা দেশে মহামারি ছড়িয়ে দিতে যা যা করণীয় আমরা তা সফলভাবে শেষ করেছি।
যার কারণে করোনাকালে ফ্রন্টফাইটার ডাক্তারসহ সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে কোথাও চিকিৎসা পাচ্ছে না। এ হাসপাতাল ও হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে রাস্তায় মরতে হচ্ছে অনেককে। আইসিইউ বা অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। এমন দুর্যোগে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার এমন চিত্র দিন দিন মানুষকে হতাশ ও আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলছে, লকডাউনের প্রথম ৬৬ দিনে কর্মহীন হয়েছে ৩.৬ কোটি লোক, অর্থনীতিবিদের মতে বর্তমানে দারিদ্র্যসীমায় ৪১.৬% মানুষ। তার মানে শুধু কোভিড আক্রান্তে রেড জোনে নয় অর্থনীতি ও সামাজিক নিরাপত্তায় বিপর্যয়ের শঙ্কা তৈরি হয়েছে। করোনার কারণে আয় কমে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর পাশাপাশি আয় ও ভোগের বৈষম্যও বেড়েছে। এমনটাই দাবি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)।
করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত আমাদের পৃথিবীতে বহু ‘অজানা চ্যালেঞ্জ’ দেখা দেবে এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এই নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আসছে বাজেটে শুধু চিরাচরিত গতানুগতিক আয়-ব্যয়, অর্থবরাদ্দ-অর্থসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলোর বাইরে বেরিয়ে এসে এমন কিছু আমরা দেখতে চাই, যেন আমাদের মনোবল চাঙ্গা এবং আমরা আশার আলো দেখতে পাই। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাজেটের প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন জায়গায় অব্যবস্থাপনা কঠোরহস্তে নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। সব শঙ্কা ও সঙ্কটকে মোকাবিলা করতে এবারের বাজেট হোক করোনাকালে ক্ষতি হওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের। দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পাস হোক বাজেট। এখনও সময় হাতে আছে, সময়ের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে মহামারি বিশেষজ্ঞের প্রস্তাবিত কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা একান্ত প্রয়োজন। ভুলে গেলে চলবে না জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা আমাদের সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
প্রধানমন্ত্রী আমাদের সব আবেদন নিবেদন আপনাকেই করতে হয়। এক হাতে একজন মানুষ কতদিকে সামাল দিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শুধু আপনি। আমাদের কি দুর্ভাগ্য আপনার সঙ্গে থেকে আপনার দর্শনে বিশ্বাস করে দেশ গড়ার কাজে উপযুক্ত ও যোগ্য সহযোদ্ধা আপনার পাশে দেখতে পাই না। প্রিয় প্রধানমন্ত্রী আজ বলা যেতে পারে অর্থনীতি তখনই পূর্ণোদ্যমে সচল হবে, যখন দেশের মানুষ অনেকটা নির্ভয়ে কর্মক্ষেত্র ও সমাজজীবনে ফিরতে পারবে। যারা শ্রমিক ও কর্মী, তাদের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে তারা কাজে ফিরতে পারবেন না বা ফিরলেও উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হবে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে সাধারণ মানুষ শুধু আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । বাকিদের কেউ বিশ্বাস করে না।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনে লকডাউন কিংবা জরুরি অবস্থা জারি করতে হবে। মানুষকে বাঁচাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিকল্প নেই। আপনার নেতৃত্বে খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় জাতীয় তহবিলের পাশাপাশি সম্মিলিত দুর্যোগ তহবিল গঠন করা হোক। ব্যক্তিক পর্যায়ে যারা শত থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক আছে তাদের প্রত্যেকের ১০ শতাংশ অর্থ কর্তন করে রাষ্ট্রীয় তহবিলে যুক্ত করে ওয়ার্ড, গ্রাম ও ইউনিয়নভিত্তিক সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নেওয়া হোক। বিশ্বাস করতে চাই, সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত ও সম্মিলিত কার্যক্রমের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।