নিউজ টাঙ্গাইল ডেস্ক: আলতো হাতে শাবল চালিয়ে ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান উঠাচ্ছিল ওরা। কাঁদায় লেপটে থাকা একগুচ্ছ ধানের শীষ টেনে বের না করতেই চিক শব্দে গর্ত থেকে লাফিয়ে বেরুলো জোড়া ল্যাংড়া ইঁদুর। শপাং শব্দে শাবলের গুঁতোয় ছেঁচে দিলো দুটোই। আবার গর্ত খোঁড়াখুড়ি। মূল ভাণ্ডারে গচ্ছিত রয়েছে ধান। ইঁদুরের সঞ্চিত সেই ভাণ্ডারের পুরোটাই চাই। এ ধানের চালে পিঠা হবে। হবে খেসারি ডালের খিচুড়ি। তাই স্কুল বাদ দিয়ে তাদের এই প্রাণান্তকর চেষ্টা।
বলছিলাম টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ননী আর সূচনার কথা। দুজন পিশাতো ভাইবোন। সম্প্রতি ঝাওয়াইল-পাকুটিয়া সড়কের অদূরে ধানী জমিতে কর্মরত দেখা যায় ওদের। ননীর বাবা রতন চন্দ্র। সূচনার বাবা নিত্য চন্দ্র। তারা সম্প্রদায়ে বাগদী। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একটি। প্রথমে ওই দুই শিশু কথা বলতে চায়নি। পরে মাথা নিচু করে ননী বলে, বোরো মৌসুমে বড়দের সঙ্গে তারাও ধান সংগ্রহে বের হয়। কদিন ধরে বড়রা ধান কাটা আর লাকড়ি বানানো নিয়ে ব্যস্ত। পিঠা খেতে চাইলে মায় কইলো ‘চরায় যা। ধান নিয়ে আয়গে। তবেই পিঠা।’
এদিকে আরেক শিশু সূচনা বলে, ‘মামী বলছে ধান আইনলে পর খেসারি ডাইলে খিচুরি অইবো। তাই আইছি।’ এই কথার মাঝে ননী ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান বের করে। আর সূচনা তার গায়ের ফ্রকের নিচের ধান রাখে। শুধু ননী আর সূচনা নয়। গোপালপুর উপজেলার সব বাগদী পল্লীর একই দৃশ্য। ধান পাকার মৌসুমে মাঠে ইঁদুরের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে ধান সংগ্রহ করেন বাগদীরা। তাতে যোগ দেয় শিশুরাও। এজন্য প্রায়ই স্কুলে যাওয়া হয় না ওদের। আমন বা বোরো মৌসুমে সংগ্রহ করা ধানকে ওরা বলে ‘রাজার ধন’। তাদের বিশ্বাস এটি প্রকৃতি প্রদত্ত। এ ধনের অধিকার শুধু তাদেরই। সরেজমিন ঝাওয়াইল বাগদী পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ৪০ শতাংশ খাস জমিতে ৩৫টি ঘর বাগদী গোষ্ঠীর। এতেই তাদের গাদাগাদি বসবাস। দিন আনে দিন খায়। কামলা খাটে, লাকড়ি চিরায়, সেলুন বা হোটেলে কাজ করে।
পাড়ার দিগেন বাগদী (৭০) জানান, ইংরেজ শাসনামলে নাটোরের জমিদার রানীভবানী ঝাওয়াইল বাজারে নায়েব কাচারি প্রতিষ্ঠা করেন। নায়েব বাবুরা খাজনা আদায়ে পালকি বা ঘোড়ায় চড়ে এলাকায় যেতেন। অবাধ্য প্রজাদের শায়েস্তার জন্য লাঠিয়ালের প্রয়োজন হতো। এ জন্য ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা থেকে আনা হয় বাগদীদের।
যতীন বাগদী জানান, পূর্ব পুরুষদের বলা হয়েছিল, ‘তোরা বাংলা মুলুকে যাবি, বড় চাকরি আর ভালো খাবার পাবি, রাজবাড়ির আঙ্গিনায় বউবাচ্চা নিয়ে থাকতি পারবি।’ কিন্তু তাদের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। এখানে লাঠিয়ালি, ঢুলি, পালকি বাহক বা পেয়াদাগিরির পেশা বেছে নিতে হয়। নায়েব কাচারির পাশেই থাকার ব্যবস্থা হয়। গড়ে উঠে বাগদী পল্লী। এভাবে কেটে গেছে দেড়শত বছর। উনবিংশ পেরিয়ে বিংশ। বিংশ পেরিয়ে একবিংশের দ্বিতীয় দশক। বংশ পরম্পরায় ষষ্ঠ উত্তরসূরিরা সেই ভিটেয় দিন যাপন করছে। যে অভাব তাড়িয়ে সুখের আশায় পূর্বপুরুষরা বাংলা মুলুকে এসেছিল উত্তরসূরিরা সেই যাতনা আরো বেশি করে ভোগ করছে। ভারত বিভক্তির পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে নায়েব কাচারি বন্ধ হয়ে যায়। তৃতীয় প্রজন্মের বাগদীরা মাটির টানে এদেশে থেকে যায়। নায়েব গোমস্তরা না থাকলেও অভিজাত পর্দানশীন মুসলমান বউঝিরা ঢুলি বা পালকিতে স্বামী বা বাপের বাড়ি আসা যাওয়া করতো। তাই এ পেশায় নতুন করে টিকে থাকার সন্ধান পায় ওরা। কিন্তু যান্ত্রিক বাহনের প্রচলনে ঢুলি-পালকি উঠে যায়। ওরা দ্বিতীয় দফায় বেকার হয় পড়ে। একদিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়ন অন্যদিকে জমিদারদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি খাস ঘোষণা দেওয়ায় মাথা গোঁজার ঠাঁই নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু হয়।
স্বপন বাগদী জানান, এরশাদ আমলে প্রভাবশালীরা ঝাওয়াইল বাগদী পল্লীতে অগ্নিসংযোগ করে তাদের উচ্ছেদ করে। পরে ভারতীয় দূতাবাসের হস্তক্ষেপে একাংশ ছেড়ে দিয়ে তাদের আপোষ করতে হয়। বহু চেষ্টাতেও বসতভিটার জমি তারা লিজ নিতে পারেনি। বাগদীরা সব সময় উচ্ছেদ আতঙ্কে থাকে।
রতন বাগদী জানান, পেটে ভাত জোটে না। পরনে কাপড় থাকে না। তাই বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখানোর সাধ্য থাকে না। এজন্য বাগদী শিশুরা স্কুল বাদ দিয়ে ধান সংগ্রহে মাঠ থেকে মাঠে ঘুরে বেড়ায়। দুই দশক আগেও পাড়ার সবার পেশা ছিলো গর্তের ধান আর জঙ্গলের আলু সংগ্রহ। এখন জঙ্গল কমে যাওয়ায় বন আলু পাওয়া যায় না। পাড়ার অনেক বাগদী এখনো ইঁদুরের গর্ত খুড়ে ধান সংগ্রহ করে। সাধারণত রোপা আমন মৌসুমেই বেশি ধান পাওয়া যায়। অনেকেই সংগ্রহ করা ধানে তিন চার মাসের খোরাকি চালায়। কথা হয়, গোবিন বাগদীর সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘অহন তেমন ধান পাওয়া যায় না। গৃহস্থরা কামলা লাগিয়ে নিজেরাই গর্তের ধান সংগ্রহ করে। আমরা ক্ষেতে নামলে বাঁধা দেয়। হের পরেও পাড়ার ছাওয়ালরা বোরো ধান কাটার সময় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে এবং আমন মৌসুম অগ্রহায়ণ-পৌষে একাজে ব্যস্ত থাকে। লেখাপড়া শিখে কি অইবো। আমাগো পাড়ায় দুজন মেট্রিক পাস দিছে। কোথাও চাকরি অইছে না। তাহলি পইরে কি হবি? টাঙ্গাইলে গোপালপুর ছাড়াও ভূয়াপুর, ঘাটাইল, ধনবাড়ি, মধুপুর ও নাগরপুর এবং জামালপুরের সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ ও জামালপুর সদর উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার বাগদী পরিবারের বাস করে। সব স্থানেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বাগদীদের অবস্থা একই রকম। বাগদীরা সব স্থানেই বর্ণ হিন্দুদের নিকট যেমন অচ্ছুত, তেমনি মুসলমানদের নিকট ছোটজাত। চায়ের দোকান বা হোটেলে ওদের জন্য আলাদা গ্লাস বা কাপ থাকে। ওদের বসার জায়গাও থাকে আলাদা।
শিশুরা স্কুলে গেলেও ছোটজাত বলে একসঙ্গে খেলতে চায় না সহপাঠীরা। এজন্য হীনমন্যতায় ভোগা বাগদী শিশুরা। লেখাপড়ায় হয় অমনোযোগী। ‘স্কুল তাদের জন্য আনন্দ গৃহ নয়’ বললেন পাড়ার লক্ষ্মী বাগদী। বাগদীরা ধর্মীয়ভাবে হিন্দু হলেও বারোয়ারি দুর্গা পূজায় ওদের অংশ গ্রহণের অধিকার নেই। আশ্বিনে দুর্গা পূজায় ওদেরকে মণ্ডপের আশপাশে যেতে দেওয়া হয় না। এজন্য দূর থেকে হাত জোড় করে মা দুর্গার নিকট প্রার্থনা করে। ওরা সংসারের শান্তির জন্য মনসা পূজা ও কালীপূজা করে। বাগদীদের বিয়ে, যৌন সম্পর্ক এবং সন্তান লালন পালনে কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিয়ে হয় তাদের সাধ্য মতে ধূমধামের সঙ্গে। যৌতুক অপরিহার্য। পূজা ও বিয়েতে মদ থাকে। বিয়ের আসরে গান ও নাচ হয়। বাগদীদের বহুল প্রচলিত বিয়ের অনেক গান এখনো টিকে রয়েছে। যেমন, ‘আইজুনি নয়া জামাই ঘুরো, তোমারি বরিয়া লিবে পুলের মত পিয়ার কুরি’। সংরক্ষণের অভাবে বাগদী সম্প্রদায়ের প্রাচীন ভাষা, সঙ্গীতসহ সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিকাশ বিশ্বাস জানান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির শিশুদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করার জন্য ভাতার ব্যবস্থা রয়েছে। এদের বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নেবেন বলে জানান।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।