কয়েক বছর আগের কথা। সম্ভবত ২০১৭ সাল। পত্রিকায় পড়েছিলাম যানজটের একটি হাস্যকার সংবাদ। ঢাকা থেকে উত্তরের পথের কোন এক জায়গায় ঈদের আগে তীব্র যানজট চলছিল। কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না মহাসড়কে কর্মরত পুলিশ। সমস্যা খুঁজতে দীর্ঘপথ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছিলেন একজন ট্রাকচালক স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে চালকের আসনে ঘুমিয়ে আছে। তার পেছন থেকে যানজট শুরু হয়েছিল। কোন এক প্রশ্নের জবাবে চালক বলেছিলেন, যানজটের কবলে পড়ে তিনি চালকের আসনেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সামনের জট খুলে গেলেও ওই চালকের আর ঘুম ভাঙেনি। ফলে ওই ট্রাকের পেছন থেকে শুরু হয়েছিল নতুন করে যানজট। ভাবা যায় ? কতোটা অসচেতন হলে মহাসড়কে স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে একজন চালক ঘুমিয়ে পড়ে। তখন না হয় জটের ওপর দিয়ে ঘটনার শেষ হলো। চলন্ত অবস্থায় চালক ঘুমিয়ে গেলে জটের পরিবর্তে প্রাণের ওপর দিয়েও যেতে পারতো। পত্রিকায় এমন সংবাদও চোখে পড়ে চালক ঝিঁমিয়ে পড়ায় বাস খাদে। জান-মাল রক্ষার্থে চালকদের সচেতনতা জরুরী।
ঈদ আসছে। ঘরমুখো মানুষ বাড়ি ফিরতে ব্যস্ত। ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ এমন কি জেলা পুলিশও মাঠে কাজ করছে। মহাসড়কেই ইফতার। মহাসড়কেই খাবার। পুলিশের এই ত্যাগ শুধু দেশের মানুষ যেন প্রিয়জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে। নির্বেগ্নে বাড়ি ফিরতে পারে। যানজটের খবর পৌঁছে দিতে সাংবাদিকরাও মাঠে কাজ করছে। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের পর যানজট নিরসনে প্রশাসন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারে। তারপরেও কি যানজট নিরসন হচ্ছে? কখনও হয়, কখনও বা হয় না। সবসময় যানজটের ভয়। আমরা সবসময় ট্রাফিক পুলিশকে দোষ দিয়ে থাকি। কর্মরত পুলিশদের দায়ী করে থাকি। সড়কের অবস্থাকে দায়ী করে থাকি। আসলেই কি তাই? যানজটের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, যানজটরোধে প্রয়োজন প্রশিক্ষিত চালক। একজন ট্রাফিক পুলিশ রোদ্রের তাপে ,বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করছে। জট নিরসনে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশ যানজট নিরসন করতে পারছে না। কারণ প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশদেও নিয়মের ব্যাখা মানতে নারাজ অপ্রশিক্ষিত চালক। এ ব্যাখা বুঝতে চালকদেরও প্রশিক্ষিত হতে হবে।
যানজট কিন্তু শুধু মহাসড়কে না। আপনার জেলা শহরেও যানজট। আপনার মফস্বল শহরেও যানজট। ছোট্ট একটি গ্রাম্য বাজারেও জট। দেশের অলিগলিতে এখন যানজট। যানজটরোধে জরুরী হয়ে পড়েছে চালকদের প্রশিক্ষিত করা। দেশের সড়কে প্রতিনিয়ত গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ফলে যানজটের মাত্রাও বাড়ছে। ২০১০ সালে দেশে ১৪ লাখ ২৩ হাজার ৩৬৮টি রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যানবাহন ছিল। এক যুগ পর ২০২২ সালে এসে ওই সংখ্যা ৫১ লাখ ১০ হাজার ৭শ ৮৬টিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন দেয়া নিয়ে এখনও কোন ধরনের সীমা নির্ধারণ করেনি। ফলে গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করলেই তা মিলছে। এটাও কিন্তু মন্দ নয়। জনসংখ্যার সাথে তালমিলিলে গাড়ির সংখ্যাটা বেড়ে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন পাবে এটাও স্বাভাবিক। এমনকি চালক লাইসেন্স পাবে এটাও অস্বাভাবিক নয়। আলোচনায় আসা যাক, লাইেেসন্সর নামে চালক কি পাচ্ছেন ? মুলত চালক লাইসেন্সের নামে একটি কাগজের সনদ পাচ্ছেন। যা মানুষ মারার সার্টিফিকেট। কেননা সার্টিফিকেট থাকলে তার যেকোন আইনি সহয়তা পাওয়ার অধিকার বেশি। লাইসেন্স না থাকলে রাস্তায় গাড়ি নামানোটাই বড় অপরাধ। লাইসেন্সধালী চালকের অনেক অপরাধ অনেক সময় সহনীয়ভাবে মাপা হয়।
ভাবা হোক ভিন্নভাবে। কিভাবে পাচ্ছেন লাইসেন্স ? দেশে চালকদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা অতি দুর্বল। মোটর যান চালকেরা নিজে নিজেই বাইক চালানো শেখেন। কেউ কেউ বাজারের চটি বই কিনলেও অধিকাংশ চালক সড়কে চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে অজ্ঞ। এরা আবার মোটরসাইকেলের পাশাপাশি হালকা যানের লাইসেন্স পেয়ে থাকে। বাস ট্রাকের চালকদের কাছ থেকে দেখে দেখে ট্রাকের সহযোগিরাও এসব যান চালানো শেখে। এদের কোন একাডেমিক প্রশিক্ষণ নেই। তবে কেন? প্রশিক্ষণ ছাড়া এসব চালকরা দক্ষ হবে কিভাবে? সড়কের নিয়ম মাথায় ডুকবে কিভাবে? বলতে পারেন প্র্যাক্টিকালি। তাই বলে কি থিওরিকালি বাদ দিতে পারেবন ? প্র্যকটিকালি শিক্ষায় লাভ যেমন আছে, অসুবিধাও তেমনি আছে। কারণ ওস্তাদের ভুল থাকলে শিষ্যেরও ভুলটা থেকে যায়। সেক্ষেত্রে একাডেমিক শিক্ষার এর পূর্ণতা পায়।
বিআরটিএ লাইসেন্স পাওয়াটাকে এতোটা সহজ করেছে যা যাত্রীদের মৃত্যুর জন্য একজন চালকের জন্য লাইসেন্স পাওয়াটাই যথেষ্ট। একজন অপ্রশিক্ষিত চালক আবেদন করলেই সে লাইসেন্স পেতে পারে। প্রথমে প্রার্থীকে আবেদন করে লার্নার নিতে হয়। এরপর একটি নির্ধারিত ক্যাটাগরিতে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। লিখিত পরীক্ষার পর ভাইবা। অতঃপর প্রার্থীর ব্যাবহারিক (প্র্যাকটিকাল) দেখাতে হয়। এখানে দুটি প্রশ্ন থেকে যায়। এরা প্রশ্নের উত্তরে যাই লিখুক, তারা প্রশিক্ষণ পেলেন কোথা থেকে? দ্বিতীয় প্রশ্ন আসে, এদের কজন পরীক্ষায় পাস করে লাইসেন্স পায়? বিআরটিএ এর পাশের চায়ের দোকানদারও জানেন কিভাবে লাইসেন্স দেয়া হয়। বড় বাবু খুশি, তো লাইসেন্স প্রাপ্তি। পরামর্শ এমন আসতে পারে , এরকম প্রহসনমূলক লাইসেন্স বিতরণের চেয়ে বিআরটিএ এর উচিৎ দেশে শক্তিশালী চালক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা। যেখোনে নির্ধারিত সময়ে একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর তাকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। অতঃপর প্র্যাকটিকালি নির্ধারিত সময় পার হওয়ার পর তাকে সড়কে ছেড়ে দেওয়া হবে। এতে দেশে দক্ষ চালক সৃষ্টি হবে। এর ফলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল খাটো হবে। সড়কে যান চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে চালকদের পূর্ণ ধারণা থাকবে। প্রশিক্ষিত হলে যানজটও নিরসন হবে।
যদি দেশের অলিগলিতে যানজটের কথা তুলে ধরা হয়, তাহলে দেশের মানুষের অন্যতম বিরক্তিকর সমস্যা হচ্ছে যানজট সমস্যা। জেলা শহরগুলোতে যেসব ছোট যান রিকশা, অটো রিকশা, সিএনজি চালিত অটো রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, পিক-আপ এসব যান চলক হয় বিদেশে ফেরত, না হয় কোন কাজ থেকে ছিটকে পড়া মানুষ। এরা বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স নিতে পারেনি। এসব যানের চালকদেও লাইসেন্স নেওয়ার সুযোগও নেই। এদের সড়কে যান চালানোর কোন ধারণা নেই। ছোট্ট যান কিনে রাস্তায় নেমেছে। এরপর থেকেই ওরাই রাস্তার রাজা। এদের কারণে রাস্তার অলিগলিতে যানজট থামছে না। এভাবে আর কতো দিন ? যানজটরোধে দ্রæত সকল চালকদের প্রশিক্ষণ, অতঃপর তাদে বিআরটিএ লাইসেন্স দেওয়াটা জরুরী হয়ে পড়েছে। সংবাদে পড়েছি, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গাড়ি বাড়ার তুলনার হারে দক্ষ চালক কম। এই কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। আবার রাস্তায় বৈধ গাড়ির পাশাপাশি রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবৈধ গাড়িও বেড়েছে। তাতেও সড়ক, পরিবেশ ও জনজীবনে চাপ বাড়ছে।
অপ্রশিক্ষিত বা অসচেতন চালকদের ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। কোথায় থামা যাবে, কোথায় গাড়িটা ঘোরানো যাবে, কোথায় অভারটেক করা যাবে এসব বিষয়ে কোন ধারণা নেই এসব অপ্রশিক্ষিত চালকদের। সড়কে লক্ষ করলে দেখা যায়, দুই লেনের সড়কে চালকরা চারলেনে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছে। কোথাও কোথাও সামনের গাড়িকে অতিক্রম করতে পেছনের গাড়ির কিছু অংশ ডানে বাড়িয়ে দিয়েছে। এভাবে দুই লেনের সড়ক চারলেনের সৃষ্টি হচ্ছে। জেলা শহরে খেয়াল করলে দেখা যায়, ইচ্ছেমতো জায়গাতে গাড়ি টার্ন করছে। গাড়িটি ঘুরাতে পেছনে জট সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। অপ্রশিক্ষত চালকদের কারণেই এমন সমস্যা বাড়ছে। সড়কে চলতে একজন চালককে নানা ধরণের নিয়ম কানুন জানতে হয়। অপ্রশিক্ষিত চালক হওয়ায় তারা এসব নিয়ম কানুন জানেন না। এদেরকে প্রশিকিবষত করাটা সময়ে দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) জানিয়েছেন,দেশে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বার্ষিক ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। যা জিডিপির দুই শতাংশ। এছাড়া শুধু ঢাকায় যানজটের কারণে বার্ষিক এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। যা জিডিপির তিন শতাংশ। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজটের কারণে বছওে মোট ক্ষতি এক লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। দেশের এই বড় ক্ষতিকে প্রতিরোধ করতে যানজট নিরসন প্রয়োজন। এরজন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষিত চালক। এই ভাবনটা শুধু ঈদের আগে নয়। রাষ্ট্রের সার্থে যানজট নিয়ে রাষ্ট্রকে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।
- লেখক: একজন সংবাদকর্মী
- রেজাউল করিম