ক্ষণস্থায়ী জীবন যেন সুচের মাথায় একখণ্ড নড়বড়ে বস্তু। ঘুম থেকে উঠে মরমি গায়ক আবদুল জব্বারের জানাজায় শরিক হয়ে মেয়েকে আনতে বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম।
বাড়ি ফিরে বিকালে টাঙ্গাইলের পথে ছিলাম। দারুসসালাম থেকে আমিনবাজার ৩ ঘণ্টা, সেখান থেকে চন্দ্রা আরও ৫ ঘণ্টা। হঠাৎই চলনরহিত হয়ে পড়লাম। থেকেও না থাকার মতো এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। মানুষ যে কত আপন, কত মহান সেদিন বাড়ইপাড়ায় এক অপরিচিত বাড়িতে দেখেছি। ১৪ ঘণ্টা কোনো চেতনা ছিল না। পরদিন টাঙ্গাইল গিয়েও কোনো শান্তি-স্বস্তি ছিল না। হাসপাতালের বেড ছিল যন্ত্রণায় কাতরানোর জায়গা। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকা বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে। চার-পাঁচ দিন কীভাবে গেছে বলতে পারব না। কত ডাক্তার, কত হিতৈষী, কত মন্ত্রী, নেতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কত আপনজন বুক জুড়িয়ে যেত। সবার কথাই একটু সুস্থ হয়ে লেখার চেষ্টা করব।কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই মিয়ানমারে নির্যাতিত ছিন্নভিন্ন ক্ষতবিক্ষত মানবতা ঘুমাতে দেয় না। কেমন যেন বুকে ’৭১-এর মতো যন্ত্রণা। প্রতিবেশী ভারত সেদিন আমাদের যদি ফিরিয়ে দিত আমরা কোথায় দাঁড়াতাম? গুমরে ফেরা আমাদের আজকের স্বাধীনতা কোথায় থাকত? মহীয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের জন্য সারা পৃথিবীকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বলেই তখন তিনি অত বড় নেতা হয়েছিলেন। ’৬২-তে ভারত চীনের সঙ্গে সুবিধা করতে পারেনি, ’৬৫-তে পাকিস্তানের সঙ্গে, তারও আগে কাশ্মীরেও তেমন উল্লেখ করার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু ’৭১-এ আমরা রক্ত ঢেলে রাস্তা করেছিলাম। সেই রাস্তায় হেঁটে বিজয় তিলক পরে ভারত বিশ্বে আজ কত নামিদামি, সম্মানী। তারা আজ গর্ব করে বলতে পারে, তারা মানবতার পাহারাদার, মনুষ্যত্বের পাহারাদার। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায়ও বলা আছে, পৃথিবীর যেখানেই নির্যাতিত মানুষ সেখানেই আমরা আমাদের সাধ্যমতো ভূমিকা রাখব। ২৪ জানুয়ারি ’৭২ টাঙ্গাইলে অস্ত্র নিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ঘোষণা আজও আমার কানে বাজে। আর্কাইভে রাখা আছে, যে কেউ শুনে নিতে পারেন। যখন মতিয়া চৌধুরীর মতো একজন মহিলা বলেন, ‘নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গারা আমাদের বোঝা’ তখন বুক ফেটে কলিজা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। মতিয়া চৌধুরী আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণায় ছিলেন না, আমাদের স্বাধীনতায়ও ছিলেন না। জাতির পিতাকে কখনো মানুষ বলে মনে করেননি। তার বিষাক্ত উচ্চারণ আমার পিতাকে প্রতি মুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তার মুখে আমরা ওসব শুনতে চাই না। তিনি বাংলাদেশও না, বাংলাদেশের প্রতিনিধিও না। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষ কখনো আমাদের বোঝা নয়। ইংল্যান্ডের রানীর রাজমুকুটে আমাদের যে কহিনুর শোভা পায় নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের বোঝা আমাদের মাথায় তার চেয়ে গৌরবের, রাজমুকুটের মতো সম্মানের। নির্যাতিত মানুষ আমাদের কাছে আশ্রয়ের আশায় আসবে আর আমরা রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকব— এটা আমাদের সভ্যতা নয়। দুস্থদের জন্য আমাদের হাতে থাকবে খাদ্য-বস্ত্র-পানীয়। যতক্ষণ মিয়ানমারে অত্যাচার বন্ধ না হয়, ততক্ষণ আমরা হিমাদ্রির মতো সিনা টান করে বুক চিতিয়ে নির্যাতিতের পাশে দাঁড়াব— সেটাই আমাদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনি জানেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সারা পৃথিবী তোলপাড় করেছিলেন। তার দূত হিসেবে ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ সারা দুনিয়া সফর করেছিলেন। আপনিও আজ বিশ্বদরবারে একজন সমাদ্রিত নেতা। রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশা নিয়ে আপনিও বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ুন। দেখবেন সারা পৃথিবী আপনাকে সমর্থন জানাবে। ইন্দিরা গান্ধীর মতোই নির্যাতিত মানবতার বন্ধু হিসেবে আপনি মর্যাদা পাবেন। আপনার একসময়ের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আমার ভাতিজা আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার। তাকে মিয়ানমার বিষয়ে বিশেষ দূতের দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিন। তার বাবা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজনমত গঠনে দারুণ সফল হয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস আপনার আবুল হাসান চৌধুরীও সফল হবে। প্রথমেই সে মিয়ানমারে যাক। গিয়ে বলুক, প্রতিবেশী হিসেবে এমন নির্যাতন আমরা সহ্য করব না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! আপনি আর চুপ করে থাকবেন না, মানবতার কান্না শোনার এটাই সময়। আপনি দৃঢ় পদক্ষেপ নিলে দেখবেন দল-মত ভেদাভেদ ভুলে সবাই আপনার পাশে দাঁড়িয়েছে। আপনার নেতৃত্ব চারদিকে প্রস্ফুটিত গোলাপের মতো ছড়িয়ে পড়ার মহান সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। সরকারের পক্ষে আজেবাজে কথা বলা লোকজনের মুখ বন্ধ করুন, তাতে কল্যাণ হবে। শিশুর ক্রন্দন শুনলে আল্লাহর দয়া ও রহমত আপনাকে আগলে রাখবে। মানুষের কান্না উপেক্ষা করে কোনো জাতি সুস্থ থাকে না। পৃথিবী মায়ের জন্য, মা-ই পৃথিবী। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সুসন্তানরা কত কষ্ট করে মাকে পিঠে বয়ে বেরিয়ে প্রমাণ করেছে মা-ই দেশ, মা-ই ধরিত্রী। নির্যাতিত মায়ের দিকে তাকিয়ে আপনি দৃঢ় পদক্ষেপ নিন। দেশবাসী আপনার সময়োপযোগী রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সাফল্য কামনায় প্রহর গুনছে। আপনি ইচ্ছা করলেই সফল হতে পারেন।
নির্যাতিত মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় সারা পৃথিবী আজ আপনাকে ধন্য ধন্য করছে। এখন প্রয়োজন বাঙালি কূটনীতিকদের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়া। ’৭১ না এলে, আমরা রক্ত না দিলে, ভারতে ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় না নিলে ’৭১-এ ভারতের মহানুভবতা বিশ্বদরবারে উঠে আসত না। ঠিক তেমনি রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে আপনার এই সুমহান পদক্ষেপ বিশ্ববাসীর কাছে এক অনুকরণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। এর চেয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব ছিল না। আপনি যদি রোহিঙ্গাদের ঢুকতে না দিতেন এত দিনে হয়তো সু চির সঙ্গে আপনার তুলনা করা শুরু হয়ে যেত।
একজন মানবতার শত্রু গণহত্যাকারী আর অন্যজন কোনো অপরাধ না করেই এক কাফেলায় শরিক হতেন কতই না দুর্ভাগ্য হতো আমাদের। সেখান থেকে রক্ষা করে গৌরবান্বিত করায় অভিনন্দন। একদিকে দুস্থ মানবতার হাত আমাদের দিকে বাড়িয়ে থাকবে, অন্যদিকে আমাদের ঔদ্ধত্য আগ্নেয়াস্ত্র সেই হাতকে উপেক্ষা করবে এ আমাদের সভ্যতা নয়। মানবতাকে ঠাঁই দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভালো কাজটি করেছেন। এখন দেশে-বিদেশে সংগঠিত হওয়ার পালা। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে দেশকে এখন এক সুতোয় বাঁধতে হবে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে হবে, মানবতার কান্না দ্বারে দ্বারে, ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বিংশ শতাব্দীতে যে সফলতা অর্জন করেছি একবিংশ শতাব্দীতে আমরা তার চেয়ে বড় গৌরবের ভাগিদার হতে পারি। আমরা আমাদের পিতাকে হত্যা করি, আমরা দুর্নীতি করি, আমরা একে অন্যকে সম্মান করতে জানি না, আমরা চর দখল করি, প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুম করি— এসব অভিযোগ নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। শুধু প্রয়োজন আপনার উদার দৃঢ় নেতৃত্বের। দেশ সবার, সবাইকে ভূমিকা রাখতে দিন। দেখবেন ’৭০-৭১-এর মতো দেশপ্রেমিক জনগণ এক কাতারে শামিল হয়ে গেছে।
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নানা কথা বলছে। বিরোধী দল হিসেবে তাদের ওসব বলার নিশ্চয়ই সুযোগ আছে। সে সুযোগ কাজে খাটাতে গিয়ে তারা লাভবান হয়নি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিয়ানমারের নির্যাতিত মানবতাকে আশ্রয় দেওয়া বিএনপি অস্বীকার করতে পারবে না। তাদের অভিযোগ, আপনি দেরি করে দুর্গত এলাকায় বা রোহিঙ্গাকবলিত এলাকায় গেছেন। আপনি না গেলেও আপনাকে অনেকে দোষ দিত না। দুর্গত এলাকায় যাওয়া-না যাওয়া কোনো কথা নয়, বড় কথা সঠিক সিদ্ধান্ত। যা আপনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিয়েছেন। আপনার জানা থাকার কথা, ’৭৩ সালে আপনার পিতার খাদ্য সাহায্যের এক চিঠি নিয়ে আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে গিয়েছিলাম। তখন ভারতীয় লোকসভায় বলা হয়েছিল, ‘আমরা যদি এক বেলা খাই ভ্রাতৃপ্রতিম বাংলাদেশের জনগণও এক বেলা খাবে। ’ আপনার সেদিনের কথা আমরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এক বেলা খেয়ে থাকব সেই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। দুর্গত-নির্যাতিত মানবতা আপনার মন্ত্রিসভার সদস্য মতিয়া চৌধুরীর জন্য বোঝা হতে পারে, আপনার জন্য যে কোনো বোঝা নয়, তারা আপনার মাথার তাজ সে তো আপনার কর্মকাণ্ডেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। আসলে কিছু কিছু মানুষ থাকে তারা নিজের বাইরে বেরোতে পারে না, অথচ তারাই আপনার আশ্রয় পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিন, দুর্গত বিশ্বমানবতাকে আশ্রয় দিন, এসব রাস্তার লোককে আবার রাস্তায় ছেড়ে দিন। রাস্তায়ই তাদের ভালো মানাবে। আর রোহিঙ্গাদের একজন একজন করে প্রত্যেক পরিবারে দিয়ে দিন। প্রয়োজন হলে আমার পরিবারে দুজন দিন। যত দিন বেঁচে আছি তাদের পিতা-মাতা বা সন্তানের যত্নে লালন-পালন করে যাই। যাতে মহাবিচারের দিনে মহান প্রভুকে বলতে পারি, আমি আমার সাধ্যমতো তোমার নির্যাতিত মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছি।
একটু ভেবে দেখুন, আপনার খাদ্যমন্ত্রী কীভাবে দেশের সম্মান ভূলুণ্ঠিত করেছেন। এই সময় তার মিয়ানমার যাওয়া শোভা পায়? বার্মার চাল সোনার দানা হলেও এখন আমাদের গ্রহণ করা উচিত নয়। ভারতে খাদ্য ঘাটতি পড়েনি। কত চালের দরকার, ৫-৬ লাখ টন। আমাকে সকালে বললে বিকালে ভারত থেকে ৬ লাখ টন চাল সংগ্রহ করে দিতে পারি। এটা গর্ব নয়, ভারতীয়দের আমি চিনি-জানি। তাদের মনুষ্যত্বের কথাই বলছি। প্রতিবেশীর জন্য তাদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও দরদ আমি দেখেছি। ভুল-ত্রুটি কালিমা সব ক্ষেত্রে থাকে, ভারত-বাংলাদেশের স্বার্থও অবশ্যই আছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই দুই দেশের মানবতা-মনুষ্যত্ব অতটা ধ্বংস হয়নি যে, এক দেশের মানুষ খাদ্যকষ্টে থাকবে আর অন্য প্রতিবেশী তা নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠবে— এমন দানবীয় আচরণ ভারত কখনো করেনি। দেব-দেবীর দেশ ভারত, মুনি-ঋষির দেশ ভারত নিশ্চয়ই তাদের কাছ থেকে মনুষ্যত্বের স্বীকৃতি পেতে কোনোকালে কোনো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার আগে জাতির পিতার ভাষণটা একবার শুনে নেবেন। আমার বিশ্বাস বুকে অনেক বল পাবেন। জাতিসংঘে প্রস্তাব করুন, যত্রতত্র জাতিসংঘের কত শান্তিরক্ষী বাহিনী, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করুন। প্রয়োজনে সেটা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী থেকে নিয়োগ করতে পারেন। দেখুন না, জাতিসংঘ কী করে, বিশ্বমানবতা কী বলে।
লেখক : রাজনীতিক।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন