এম সাইফুল ইসলাম শাফলু : টাঙ্গাইলের সখীপুরে করোনাকালের এ বছরে (২০২০) ৭৫৭টি বিবাহ হলেও ৪৭৬টি বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটেছে। এর আগে ২০১৯ সালে ৫৩০টি ও ২০১৮ সালে ৫৫৬টি বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। বাল্যবিবাহ, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর উদাসীনতা, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামীর মাদকাসক্তি, দীর্ঘদিন স্বামীর প্রবাসে থাকা, শ্বশুর-শাশুড়ির নির্যাতন, যৌতুকের জন্য চাপ, স্বামীর নির্যাতন এসব কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
উপজেলা নিকাহ রেজিস্টার সমিতি সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৪টিসহ মোট ১২টি কাজির কার্যালয় রয়েছে। এ ১২টি কার্যালয়ে ২০২০ সালে ৭৫৭টি বিবাহ ও ৪৭৬টি বিচ্ছেদের (তালাক) ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে শুধু ছেলেদের পক্ষ থেকে ১২টি তালাক দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের পক্ষ থেকে ২২৮ ও যৌথভাবে (ছেলে-মেয়ে উভয়পক্ষের সমন্বয়ে) তালাক হয়েছে ২৩৬টি।
২০২০ সালে উপজেলার কাঁকড়াজান ইউনিয়নে বিয়ে হয়েছে ৪৮টি আর বিচ্ছেদ হয়েছে ৬২টি, কালিয়া ইউনিয়নে বিয়ে ১৩০, বিচ্ছেদ ১০২, বহুরিয়া ইউনিয়নে বিয়ে ৩৮, বিচ্ছেদ ১৫, হাতীবান্ধা ইউনিয়নে বিয়ে ৬২, বিচ্ছেদ ৫২, যাদবপুর ইউনিয়নে বিয়ে ১০৬, বিচ্ছেদ ২৫, গজারিয়া ইউনিয়নে বিয়ে ৪৩, বিচ্ছেদ ২৬, বহেড়াতৈল ইউনিয়নে বিবাহ ৩১, বিচ্ছেদ ৩৯ এবং দাড়িয়াপুর ইউনিয়নে বিবাহ ৭২ ও বিচ্ছেদ ৩২টি। পৌরসভার ৪টি কার্যালয়ে ২২৭টি বিবাহ হলেও বিচ্ছেদ ঘটেছে ১২৩টি।
কালিয়া ইউনিয়ন নিকাহ ও তালাক রেজিস্ট্রার (কাজি) মাহবুব সাদিক বলেন, ‘কনের পক্ষের তালাককে ডি-তালাক, ছেলের পক্ষের তালাককে বি-তালাক ও ছেলে-মেয়ে উভয় পক্ষের সমঝোতার তালাককে সি-তালাক বলা হয়। করোনার কারণে বিবাহের সংখ্যা এ বছর কম হয়েছে।
উপজেলা কাজি সমিতির সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শফিউল ইসলাম ওরফে কাজি বাদল বলেন, বাল্যবিবাহ, স্বামীর বিদেশে থাকা ও পরকীয়াঘটিত নানা জটিলতা নিয়ে প্রথমে দুই পরিবারে ফাটল ধরে, পরে তা বিচ্ছেদে রূপ নেয়। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের তৎপরতায় আগের তুলনায় এখন বাল্যবিবাহ কম হচ্ছে। ফলে আগের চেয়ে বিবাহ বিচ্ছেদও অনেকটা কমে আসছে। পর্যায়ক্রমে আরও কমে যাবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নারী বলেন, সামান্য কারণে একজন নারী কখনো তাঁর স্বামীকে তালাক দেন না। সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যখন সীমা অতিক্রম করে, তখন বাধ্য হয়েই নারীদের তালাকের আশ্রয় নিতে হয়।
স্থানীয় একটি কলেজের এক ছাত্রী বলেন, ‘বছর দেড়েক আগে দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে হয়। স্বামী এসএসসি পাস করতে পারেনি, পোলট্রি খাদ্যের ব্যবসা করেন। স্বামীর চেয়ে বেশি শিক্ষিত হলে তাকে মানব না, এ যুক্তিতে সে আমাকে পড়াতে চায় না। ছাত্রী নিবাসে থাকার খরচও দেয় না। কয়েক দিন আগে শুনলাম, আমার স্বামী আমাকে তালাক দিয়েছে এবং আরেকটি বিয়েও করেছে। এখনো আমি তালাকনামা পাইনি। এখন বাধ্য হয়েই আমার পরিবার মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
আরেকজন ছাত্রী বললেন, ‘আমার স্বামী বিয়ে করে ১৫ দিনের মাথায় বিদেশ চলে যায়। বিয়ের সময় শর্ত ছিল, আমাকে পড়াশোনা করতে দেওয়া হবে। কিছুদিন পর স্বামী বিদেশ থেকে সাফ বলে দেয়, আর পড়াশোনা করা যাবে না। কারণ জানতে চাইলে স্বামী ফোনে বলেন, আমি নাকি অন্য কারও সঙ্গে প্রেম করছি। পড়াশোনা করলে পরে স্বামীকে ফেলে চলে যাব। এসব আজগুবি কথা বলে আমার পড়াশোনা বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়। আমি পড়াশোনা চালিয়েই যাই। এরপর থেকে স্বামী কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। আমার মা-বাবাই আমার পড়াশোনার খরচ দেন। কোনো ফোনও করে না। আমাকে তালাক দেবে বলে হুমকিও দেয়। দুই বছর আমার স্বামী আমার খোঁজ না নেওয়ায় আমিই ওকে তালাক দিই।’
সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বাবুল আকতার বলেন, আগের চেয়ে নারীরা শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ায় তাঁদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন পক্ষে থাকায় ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পক্ষে তালাকের সংখ্যা বেশি। এছাড়াও বাল্যবিবাহের কারণেই মূলত বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বেশি ঘটে।
এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ফিরোজা আক্তার বলেন, যুগ যুগ ধরে পুরুষদের অত্যাচার সহ্য করে নীরবে নারীরা সংসার করেছে। এখন মেয়েরা অনেক সচেতন ও শিক্ষিত। তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় সমাজে তাঁদের মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে এখন মেয়েরা আর আগের মতো নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করতে চায় না।
প্ঙ্গাা্া