দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। তবে এই মূল্যায়ন পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে শুরু করা হবে। পাঠদানের সময় ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ (শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন) ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে ‘সামষ্টিক মূল্যায়নের’ ভিত্তিতে শিক্ষার্থী পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে। আর প্রথম পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে ‘দশম শ্রেণির’ পাঠ্যসূচি অনুযায়ী দশম শ্রেণিতেই।
জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখায় পরীক্ষা নিয়ে এমনই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা ও দেশের শিক্ষাবিদদের মতামতের আলোকে পরীক্ষা নিয়ে এই পরিবর্তন আনা হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এই রূপরেখা তৈরি করেছে।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই রূপরেখার আলোকে কারিকুলাম ও পরীক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন পর্যায়ক্রমে শুরু হবে। প্রথম পাবলিক পরীক্ষা (এসএসসি) অনুষ্ঠিত হবে দশম শ্রেণিতে। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির আলোকেই এই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ থাকবে না। সবাইকে ১০টি বিষয় পড়তে হবে। এর মধ্যে পাঁচটি বিষয় এসএসসি পরীক্ষা হবে। সেগুলো হলো: বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান।
এছাড়া বাকি পাঁচটি বিষয়—জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ভালো থাকা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতিতে পুরোটাই ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৩২ কার্যদিবসে এসএসসি পরীক্ষা হয়। নতুন পদ্ধতি কার্যকর হলে পাঁচ কার্যদিবসেই এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবে।
আর একাদশ শ্রেণি শেষে ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির সম্মিলিত ফলের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। বর্তমানে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে একটি পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এই স্তরে ৩০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে।
নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে। এসব শ্রেণিতে কোনো বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। প্রাক প্রাথমিক, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২০২২ এবং ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু হবে।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে ৭০ শতাংশ নম্বরের ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের। এই পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হবে চতুর্থ শ্রেণিতে ২০২৪ এবং পঞ্চম শ্রেণিতে ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে। এছাড়া ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ৬০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ২০২২ এবং ৮ম শ্রেণিতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
তবে এই রূপরেখায় পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি পরীক্ষার কথা উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ দুটি পরীক্ষার কথা উল্লেখ নেই। সরকার এটা নির্বাহী আদেশে নিয়ে থাকে। যদি সরকার চায় তাহলে পরীক্ষা নিতে পারবে। তবে মূল্যায়নের কাঠামো এই রূপরেখা অনুযায়ী হবে। সরকার নির্বাহী আদেশে পিইসি পরীক্ষা নিতে চাইলে ৭০ শতাংশ ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং ৩০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে নিতে হবে। তারপরই চূড়ান্ত ফল হবে।
পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে রূপরেখায় বলা হয়েছে, শিক্ষাক্রমে যোগ্যতাকে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, গুণাবলি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি বিশেষত পাবলিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীর মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ মূল্যায়ন করে। তাই প্রচলিত পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রেখে শিক্ষাক্রমের মূল উদ্দেশ্য অর্থাত্ শিক্ষার্থীর জ্ঞানের পাশাপাশি দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, গুণাবলি ও মূল্যবোধ অর্জন সম্ভব হবে না। তাই পাবলিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শিখনকালীন মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন, জাতীয় দিবসে খোলা: বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি সাধারণত একদিন (শুক্রবার)। নিজেদের সিদ্ধান্তে কোনো প্রতিষ্ঠান দুইদিনও ছুটি রাখে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও দুইদিন ছুটি থাকবে।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় মূল্যায়নকে কেবল শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশের মূল্যায়ন ও সে সঙ্গে শিখনের মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।