বাল্ক এসএমএস সেবায় নজরদারি ও জয়ের চাঁদাবাজির অভিযোগ – SISPAB

0
396

গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিটিআরসি ভবনের সামনে শতাধিক বাল্ক এসএমএস লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে ব্যবসায়ীরা ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেন, যেখানে প্রধান দাবি হলো ইনফোজিলিয়নের কার্যক্রম বাতিল করা এবং এসএমএস সেবা খাতে নজরদারি বন্ধ করা।

বাংলাদেশে মুঠোফোনের এসএমএস সেবা খাতে নজরদারি ও চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে সরব হয়েছে এসএমএস প্রোভাইডাররা এসএমএস এন্ড ইনফরমেশন প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (SISPAB) অভিযোগ করেছে যে, বিগত সৈরাচার সরকার-সমর্থিত প্রতিষ্ঠান ইনফোজিলিয়ন টেলিটেক বাংলাদেশ গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে এবং প্রতিটি এসএমএসের জন্য জোরপূর্বক অতিরিক্ত ৫.৭৫ পয়সা আদায় করছে যা দিনশেষে দেশের জনগনের পকেট থেকেই ব্যয় হচ্ছে। ২০২৩ সালের ১৬ মে একটি নিয়ন্ত্রক কমিশনের আদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি এই কাজটি এককভাবে শুরু করে, যা এসএমএস সেবার মানের ক্ষতি, ব্যবসায়িক ক্ষতি এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।

অভিযোগের পটভূমি

সিসপ্যাব জানিয়েছে, ইনফোজিলিয়ন টেলিটেক বাংলাদেশ নামের এই এনএমপি (নেশনওয়াইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম) প্রতিষ্ঠানটি এসএমএস সেবায় নজরদারি করতে বাধ্য করছে, যার ফলে গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য তাদের কাছে যাচ্ছে। বিশেষ করে, ব্যাংক লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত OTP কোড সহ অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্যও এই কোম্পানির হাতে পড়ছে। এ ধরনের নজরদারি গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করছে।

তাছাড়া, এই প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ মোবাইল নম্বর পোর্টাবিলিটি হলেও মাস্কিং SMS এর ক্ষেত্রে তা সঠিকভাবে কার্যকর নয়। বরং অপারেটর পরিবর্তীত নম্বরে SMS গেলে তা নন মাস্কিং হিসেবে যায় যদিও সেক্ষেত্রে মাস্কিং এর চার্জই কাটে যা গ্রাহকদের সাথে প্রতারণার সামিল। এই সমস্যার সমাধান না করেই BTRC এর কিছু অসাধু কর্মকর্তার জোর যবরদস্তি ও ইনফোজিলিয়নকে ব্যবসা পাইয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। যার ফলে এগ্রিগেটরসহ পুরো টেলিকম ইন্ডাস্ট্রি একপ্রকার অসহায় হয়ে তাদের এখানে সার্ভিস সিফট করতে বাধ্য হয়। দীর্ঘ ১.৫ বছর পাড় হলেও তারা এই সমস্যার সমাধান অদ্যাবদি করেনি।

প্রতিটি এসএমএসের সঙ্গে জোরপূর্বক ৫.৭৫ পয়সা অতিরিক্ত চার্জ যুক্ত করার কারণে এসএমএস সেবার খরচ বেড়েছে, যা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিকর ও সাধারণ জনগণকে ৬ পয়সা বেশি প্রদান করতে হচ্ছে । এই অতিরিক্ত চার্জের ফলে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং এসএমএস সেবা দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এসএমএস এগ্রিগেটরগণ বলছেন, এই অবৈধ আদায়ের কারণে এসএমএস ব্যবসায়ীরা নিজেদের খাতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন, যা এসএমএস সেবার ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য হ্রাস ঘটিয়েছে।

বিক্ষোভ ও দাবিসমূহ

বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বিটিআরসি ভবনের সামনে শতাধিক এসএমএস ব্যবসায়ী বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভে ব্যবসায়ীরা ৭ দফা দাবি উত্থাপন করেন, যেখানে প্রধান দাবি হলো ইনফোজিলিয়ন টেলিটেকের কার্যক্রম বাতিল করা এবং এসএমএস সেবা খাতে নজরদারি বন্ধ করা।

বিক্ষোভ শেষে সিসপ্যাব সভাপতি ফিরোজ মাহমুদ এবং সহ-সভাপতি মঈন উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল বিটিআরসি ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল হক স্বীকার করেন যে তিনি পুরো প্রযুক্তিগত দিকটি ভালোভাবে বোঝেন না, তবে বিষয়টি গুরুতর হওয়ায় মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দিয়েছেন এবং দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।

৭ দফা দাবির বিস্তারিত

১. A2P এসএমএস কমন ইন্টারকানেকশন প্ল্যাটফর্ম বাতিল করা: এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে প্রতিটি এসএমএস নজরদারি করা হচ্ছে, যা গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে এবং এসএমএস সেবার মান নষ্ট করছে।

২. দুর্নীতিগ্রস্ত বিটিআরসি কর্মকর্তাদের অপসারণ: ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, বিটিআরসি’র কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা ইনফোজিলিয়নকে অবৈধভাবে সমর্থন করে আসছে এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

৩. বাংলা ভাষায় এসএমএস পাঠানোর বাধ্যবাধকতা বাতিল করা: বাংলা এসএমএসের অক্ষর সীমাবদ্ধতার কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ইংরেজিতে ১৬০ অক্ষরের মধ্যে একটি এসএমএস পাঠানো সম্ভব হলেও বাংলায় সেটি মাত্র ৭০ অক্ষর। এ কারণে বাংলা এসএমএসের খরচ দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে, যা ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি বোঝা সৃষ্টি করছে।

৪. কন্টেন্ট ভ্যালিডেশন সিস্টেম তুলে দেয়া: এসএমএস কন্টেন্টের উপর অপ্রয়োজনীয় ফিল্টারিং এবং যাচাই সিস্টেমের কারণে সেবা বিলম্বিত হচ্ছে। এই সিস্টেমের কারণে এসএমএস বিলম্বিত হওয়ায় ব্যাংকের OTP এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সময়মতো পৌঁছায় না।

৫. রেভিনিউ শেয়ার এবং কল্যাণ তহবিলে চাঁদা বন্ধ করা: ইনফোজিলিয়নের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করা অতিরিক্ত চাঁদা বন্ধ করতে হবে। এসএমএস ব্যবসায়ীরা এই চাঁদাকে অবৈধ ও অযৌক্তিক বলে দাবি করছেন।

৬. আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবায় স্বাধীনতা প্রদান: আন্তর্জাতিক এসএমএস সেবা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাধীনতা ও অনুমতি প্রদান করতে হবে, যা বর্তমানে সীমাবদ্ধ।

ইনফোজিলিয়ন টেলিটেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ

সিসপ্যাবের সভাপতি ফিরোজ মাহমুদ বলেন,

“ইনফোজিলিয়ন টেলিটেক অবৈধভাবে এসএমএস নজরদারি করছে এবং ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রাহকদের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য, সরকারি সেবা সম্পর্কিত তথ্য এবং অন্যান্য সংবেদনশীল ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।”

তিনি আরও জানান, “আমরা চাই এই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করা হোক এবং এর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হোক। এসএমএস ব্যবসায়ীরা এটির কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং এসএমএস সেবার মানও নষ্ট হচ্ছে।”

অতীতের অভিযোগ ও প্রমাণ

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারের আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের মদদে এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হচ্ছে এবং বিটিআরসি’র কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তাদের সহযোগিতা করছে। এর আগে সিসপ্যাবের পক্ষ থেকে বিটিআরসি’র কাছে একাধিকবার অভিযোগ দায়ের করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যার ফলে এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা এবং বিটিআরসি কর্মকর্তাদের ভূমিকা

এই সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি এবং ১.৫ বছর পেরিয়ে গেলেও সমস্যাটি চলমান রয়েছে। বিটিআরসি’র ডেপুটি ডিরেক্টর মাহদী আহমদ সহ কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় ইনফোজিলিয়ন টেলিটেকের চাপের মুখে পড়ে এসএমএস এগ্রিগেটর ও টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির পুরো অংশ তাদের সেবা ইনফোজিলিয়নের কাছে সিফট করতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন যে, এই কর্মকর্তাদের কারণে পুরো খাতটিই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, এবং তারা এই সমস্যার সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

বিটিআরসি’র এই অসাধু কর্মকর্তারা ইনফোজিলিয়নের পক্ষ নিয়ে এসএমএস সেবা ব্যবসায়ীদের উপর চাঁদাবাজির শৃঙ্খল তৈরি করেছে, যা এসএমএস ব্যবসার জন্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলছে। এই কারণে ব্যবসায়ীরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং এসএমএস সেবা খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর হস্তক্ষেপ দাবি করছেন।

ভবিষ্যতের করণীয়

সিসপ্যাবের দাবির মধ্যে রয়েছে ইনফোজিলিয়ন টেলিটেকের কার্যক্রম দ্রুত বন্ধ করা, এসএমএস খাতে বৈধ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা, এবং এসএমএস সেবার মান উন্নত করা। এসএমএস ব্যবসায়ীরা একমত যে, এই প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলে এসএমএস সেবা আরও সুষ্ঠু ও দ্রুত হবে এবং খরচও কমে যাবে।

সিসপ্যাবের দাবি, এসএমএস খাতে এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজির অবসান ঘটানো জরুরি, যাতে ব্যবসায়ীরা সুষ্ঠুভাবে এসএমএস সেবা পরিচালনা করতে পারে।

নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।