নিজস্ব প্রতিবেদক: টাঙ্গাইলের নিউ ধলেশ্বরী নদীর সাত কিলোমিটার এলাকার কয়েকটি স্পটে তীর কেটে বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে মাটিখেকোরা। প্রতিদিন রাত নামলেই শুরু হয় তীর কাটার মহোৎসব। দিনের আলোয় সুনশান নিরবতা থাকলেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাত ৯টার পর নদীতীর এলাকায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। জনস্বার্থে নদীতীর ও জমির টপসয়েল কাটা বন্ধে পৌরসভার উদ্যোগে মাইকিং করা হলেও কেউ কর্ণপাত করছেনা।
এনিয়ে কালিহাতী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সিফাত বিন সাদেকের নেতৃত্বে ভ্রাম্যান আদালতের একাধিক অভিযান চালানো হচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আদালতের অভিযান চলাকালে আত্মগোপনে থেকে অভিযানের পর পরই কৌশলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে মাটি-বালু কেটে বিক্রিতে মেতে ওঠছে।
জানা যায়, নিউ ধলেশ্বরী নদীর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া ও এলেঙ্গা পৌরসভার অংশে ছয়টি স্পটে দুই তীর কেটে মাটি ও বালু বিক্রি করছে এক শ্রেণির সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী। স্পটগুলো হচ্ছে- টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের বড় বাসালিয়ায় দুইটি স্পট এবং এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা, হায়াতপুর, চরবাঁশি।
এর মধ্যে বড় বাসালিয়ার দুইটি স্পটে উজ্জল, খোকন, সুমন, নাজমুল, আলামিন, জয়, একই এলাকার অপর স্পটে ফেরদৌস, নাজু, এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা স্পটে অসিম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, এসকে আলম, হায়াতপুর স্পটে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. ছানোয়ার হোসেন, এরশাদ, বকুল তালুকদার, আরিফ, লাবু, জাহিদ, চরবাঁশি দুইটি স্পটে আওয়ামী লীগ নেতা মাজেদুর রহমান, আব্দুল হালিম, অপর স্পটে রফিক, শফিক প্রমুখ।
সরেজমিনে দেখা যায়, এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা স্পটে নিউ ধলেশ্বরী নদীর বামতীরে প্রায় আটশ’ মিটার এলাকার তীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করা হয়েছে। উজান ও ভাটিতে মাটি কাটার ফলে স্থানীয় মৃত সোলেমান মিয়ার প্রবাসী ছেলে শরীফদের বসত বাড়ি পুরোপুরিভাবে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। সোলেমান মিয়ার এক ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে মেয়েদের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। শরীফ প্রবাসে থাকেন। বাড়িতে শুধুমাত্র তার মা শাহিদা আক্তার বসবাস করেন।
শাহিদা আক্তার জানান, তাদের বাড়ির তিন দিকে মাটি কেটে স্থানীয় ব্যবসায়ী অসিম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও এসকে আলমরা বিক্রি করেছে। তিনি বার বার নিষেধ করলেও তারা মানেনি। পৌরসভায় জানিয়েও কোনো সুফল হয়নি। বর্ষা মৌসুমে তার বাড়ি নদী গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার সমুহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
হায়াতপুর স্পটে দিন-রাত চারটি ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) দিয়ে ২০-২৫ ফুট গভীর করে নদীতীর কেটে প্রতিদিন দেড় শতাধিক গাড়ি মাটি-বালু বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দিনের আলোয় কয়েকদফায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানোর কারণে এখন রাত ৯টার পর থেকে নদীতীর সহ আশপাশের তিন ফসলি জমি কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে।
এ স্পটের মাটি ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করে জানান, তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নদীতীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করছেন। এজন্য তারা এখন দিনে মাটি কাটেন না বা পরিবহণও করেন না। তাছাড়া আগামি বর্ষা মৌসুমে যমুনার পলি জমে কেটে নেওয়া জমিগুলো ভরাট হয়ে যাবে।
চরবাঁশি স্পটে গিয়ে দেখা যায়, নিউ ধলেশ্বরী নদীর ডানতীরে তিনটি ভেকু বসিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিকে সুনশান নিরবতা। রাত ৯টার পর সেখানে মাটি-বালু ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। শ্রমিকরা মাটি কেটে ভেকু দিয়ে ট্রাক ভরে দেন। কেউ মাটি কাটা তদারকি করেন, কেউ পরিবহণের ট্রাকে ট্রিপ দেন। এ লক্ষে রাতে সেখানে অস্থায়ী দোকানও বসে। বালু ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীরা খাওয়া-দাওয়া করে থাকেন।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়ার দুইটি স্পটে তিনটি ভেকু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে দিনের আলোয় কোন কাজ করা হয়না। রাত নামলেই পুরো এলাকা শ’ শ’ ছোট ছোট ট্রাক ও ভেকু মেশিনের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। নিউ ধলেশ্বরী নদীর বামতীরে জমে থাকা পলি কেটে বিক্রি করা হয়।
এদিকে ওই স্পট দুটি টাঙ্গাইল সদর উপজেলা ও কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। জমে থাকা পলিমাটি সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া ও এলেঙ্গা পৌরসভার যৌথ অংশে হলেও তা কালিহাতীর এলেঙ্গা পৌরসভার সড়ক দিয়ে পরিবহণ করতে হয়। ফলে প্রায় দুই কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা ব্যয়ে সদ্য নির্মিত পৌরসভার সড়কটি যেকোন সময় ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নদী তীরবর্তী স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করার ফলে বর্ষা মৌসুমে তীব্র ভাঙনে বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। তীরবর্তী সহ আশপাশের তিন ফসলি জমিগুলো অনাবাদী থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
রাতের আঁধার ভেদ করে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে ট্রাক চলাচল করায় শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে- গ্রামীণ সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধুলাবালির কারণে আশপাশের বাড়ি-ঘরে রাখা খাবারগুলোতে বালুর স্তর পড়ে নষ্ট হচ্ছে। নারী-শিশু ও বয়ষ্করা শ্বাসকষ্ট সহ বালু ও বায়ু বাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করে জানায়, মাটি-বালু ব্যবসায়ীরা এলাকায় খুবই প্রভাবশালী। কেউ কেউ সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাদেরকে অবৈধ মাটিকাটা ও বালু উত্তোলন বন্ধে বার বার অনুরোধ করলেও কেউ শুনেনি। এলাকার কেউ প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলে তার বিরুদ্ধে মাটি-বালু ব্যবসায়ীরা ভিন্ন অজুহাতে মামলা দিয়ে হয়রানি করে থাকে। এ কারণে ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনা।
এলেঙ্গা পৌরসভার কাউন্সিলর সুকুমার ঘোষ জানান, নিউ ধলেশ্বরী নদীতীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি বন্ধে প্রশাসনের পাশাপাশি তারা এলাকার মানুষদের এ বিষয়ে সচেতন করতে কাজ করছেন। তিনি মাটি-বালু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতা করছেন না বলে তাকে নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানোর অপচেষ্টা করছে।
এলেঙ্গা পৌরসভার মেয়র নুর-এ-আলম সিদ্দিকী জানান, পৌরসভার যে কোন এলাকায় মাটি-বালু বা নদীতীর কিংবা নদী খনন করে বালু উত্তোলন বন্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে ৩-৪ দিন ধরে মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়া ‘টাঙ্গাইল জেলার ১০টি পৌরসভার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের’ রাস্তা ক্ষতিগ্রস্তের আশঙ্কায় চলাচলরত বালুবাহী ট্রাক বন্ধ করার জন্য বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) এলেন/পৌঃ/প্রকৌঃ/২০২৪/১৯৫২ নং স্মারকমূলে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও কালিহাতী উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যথানিয়মে পত্র দিয়েছেন।
টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু বা মাটি উত্তোলনের অধিকার কারো নেই। ইতোপূর্বে খননকৃত ড্রেজড ম্যাটারিয়াল সংশ্লিষ্ট কমিটি টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করেছে এবং সেগুলো অপসারণও করা হয়েছে। নতুন করে নদী খনন করার কোন প্রকল্প নিউ ধলেশ্বরী নদীতে নেই।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. কায়ছারুল ইসলাম জানান, শুধু নদীতীর নয় যে কোন এলাকার মাটি-বালু উত্তোলন বা কেটে বিক্রি করার অনুমতি কাউকে দেওয়া হয়নি। নিউ ধলেশ্বরী নদীর পৌলি এলাকায় মহাসড়কের আশপাশে তীর কেটে বিক্রি করার খবরে প্রায় প্রতিদিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কাউকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই- অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউজ টাঙ্গাইলের সর্বশেষ খবর পেতে গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি অনুসরণ করুন - "নিউজ টাঙ্গাইল"র ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।