এম সাইফুল ইসলাম শাফলু, ‘নদী, চর, খাল-বিল, গজারির বন-টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’। টাঙ্গাইলের সখীপুরের সেই ঐতিহ্যবাহী ‘শাল-গজারির বন’ আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। শাল-গজারি বন বিলীন হওয়ার সাথে সাথে বিলীন হচ্ছে শিয়াল, খেঁকশিয়াল, সজারু, বনবিড়াল, কাঠবিড়ালি, বাঘডাসাসহ নানা প্রজাতির বণ্যপ্রাণী, পাখপাখালি, কীটপতঙ্গের অস্তিত্বও বিলীন হচ্ছে। এতে করে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। নেমে আসছে পরিবেশের বিপর্যয়। অপরতিকে ওইসব বন-জঙ্গল কেটে দিনদিনই নতুন নতুন বাড়ি-ঘর,দোকানপাট, পোল্ট্রি খামার নির্মাণ এমনকি মাটি কেটে বনের জমি নীচু করে আবাদও করা হচ্ছে।
স্থানীয় বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় মোট বনভূমির পরিমান প্রায় ৪৫ হাজার একর। এরমধ্যে আট হাজার ২৭৬ একর জমি জবর দখল হয়ে পড়েছে। শাল গজারি গাছ রয়েছে প্রায় চার হাজার একর জমিতে। টাঙ্গাইল বন বিভাগের বহেড়াতৈলী রেঞ্জের সদর, ডিবি গজারিয়া, কাঁকড়াজান, হাতিয়া রেঞ্জের সদর, কালমেঘা, কড়ইচালা, বাজাইল, কালিদাস বিট ও বাঁশতৈল রেঞ্জের নলুয়া বিটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইসব বিটে প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা শাল-গজারির বন টিকিয়ে রাখতে স্থানীয়দের মাঝে প্লট আকারে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় কাঠ চোর ও কাঠ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে স্থানীয় বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে গহিন বনে এসব গজারি গাছ দিনের বেলায় কেটে রাতের বেলায় ট্রাক ও ট্রলিতে করে পাচার হচ্ছে। কিছু গজারি গাছ বিভিন্ন করাতকলে গিয়ে চেরাই হচ্ছে আবার কিছু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শহরের বহুতল ভবন নির্মাণে পাইলিংয়ের কাজে।
সরেজমিন ওইসব বনা লে ঘুরে দেখা যায়, বহেড়াতৈলী রেঞ্জের সদর বিটে আমতৈল,পেতুনিচালা, নির্গাছচালা, হলদেচালা,ভুগলিচালা,ধোপারচালা,সর্দারচালা, কাচিকাটাচালা, শাহেরচালা, মীরেরচালা, মুন্সিরচালা, গোয়াইলা চালা, ডিবি গজারিয়া বিটে দেউবাড়ি, লাঙুলিয়া, কৈয়ামধু, হাতিয়া রেঞ্জের সদরবিট, কালমেঘা বিটের কালমেঘা গ্রামে, কালিদাস বিটের কালিদাস, গজারিয়া, প্রতিমা বংকীতে, নলুয়া বিটের নলুয়া, ঘেচুয়া এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে গজিয়ে ওঠা শাল-গজারি বন রয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ-ওইসব গজারি বনে রাতের বেলায় ট্রাক ও ট্রলি ঢুকে দিনের বেলায় কেটে রাখা গাছ তুলে এনে কাঠ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন করাতকলে দিনরাত চেরাই করছে। আবার কিছু কিছু গাছ দেশের বিভিন্ন অ লে পাচার করা হচ্ছে। তাদের অভিযোগ রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রভাবশালী গাছ চোরারা গজারি কাঠ পাচারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তারা প্রশাসনের নাকের ডগায় দীর্ঘদিন ধরে তারা এ ব্যবসা করে আসলেও প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। এলাকার সচেতন মহল মনে করেন এদেরকে দমন করতে পারলেই সখীপুরের শাল-গজারি বন রক্ষা হবে।
আমতৈল ও বহেড়াতৈল গ্রামের বাসিন্দা একাধিক প্লট মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টাকার বিনিময়ে অনেক দূরের লোকদের কিছু প্লট দেওয়ায় সেইসব প্লটেই বেশি চুরি হচ্ছে। আমতৈল গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধ আবু সাঈদ বলেন, ‘আগে কত গজারি গাছ আছাল,বাঘের ডরে গরু চড়াইতে পারি নাই। অহন আর সেইগুলান নাই। চুরেরা সব খাইয়া হালাইছে ।’
বহেড়াতৈল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনিরুজ্জামান (মঞ্জু) অভিযোগ করে বলেন, ‘স্থানীয় কাঠচোরদের সঙ্গে আঁতাত করে বন কর্মকর্তারা বন উজারে ভূমিকা রাখছে। চার বছর আগেও আমার এলাকায় অনেক গজারি বন ছিল, আস্তে আস্তে এসব বন হারিয়ে যাচ্ছে।’ জানতে চাইলে বহেড়াতৈল সদর বিটের কর্মকর্তা হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কয়েক মাস আগে যোগদান করেছি। আমি আসার পর গজারি গাছ কাটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। আমি শুনেছি আগে এই এলাকায় অনেক গজারি বন ছিল। গজারি গাছ প্লট আকারে জন সাধারণের মাঝে ভাগ করে দেওয়ায় এখন গাছ কাটা আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গেছে।’
এদিকে ওই রেঞ্জের ডিবি গজারিয়া, কাঁকড়াজান ও এমএমচালা বিটে দেখা যায়, বন কেটে বনের জমিতে অনেকেই নতুন নতুন বাড়ি-ঘর তুলেছেন। এ প্রসঙ্গে এমএমচালা বিট কর্মকর্তা আলাল বলেন, আমি আসার অনেক আগেই আমার বিটে বাড়িÑঘর উঠেছে। আমার সময়ে নতুন কোনো বাড়ি-ঘর তুলতে দেওয়া হয়নি।
এ ছাড়াও হাতিয়া রেঞ্জের সদর, কালিদাস, কড়ইচালা, বাজাইল ও কালমেঘা বিটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওইসব বিটেও গজারির বন একই কায়দায় বিলীন হচ্ছে। এছাড়াও হতেয়া রেঞ্জের কালমেঘা ও কালিদাস বিটে একদল ব্যবসায়ী গজারি গাছের গোড়া ও গজারি গাছ পুড়ে কয়লা বানিয়ে বিক্রি করার অভিযোগ করেন স্থানীয় লোকজন।
এ প্রসঙ্গে হাতিয়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা (আরও) খসরু আলম বলেন, আমার এলাকায় যেসব গজারি গাছ কাট, ও কাঠ পোড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে, সেগুলো ব্যক্তি মালিকানা জমিতে। তারপরেও কেউ গজারি গাছ কাটলে ও পুড়ালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বাঁশতৈল রেঞ্জের নলুয়া বিটের ঘেচুয়া এলাকায় বনের ভেতর অনেকগুলো বাড়ি-ঘর উঠেছে। এছাড়াও ওই বিট কার্যালয়ের ২০০ গজ দূরে বনের দুই একর জমি দখল করে নলুয়া-টাঙ্গাইল সড়কের পাশে স্থানীয়রা ‘এয়ারফোর্স’ নামের বাজার বানিয়েছেন। এয়ারফোর্স বাজারের একাধিক ঘর মালিক বলেন, বন-জঙ্গলে ঘেরা থাকায় এইস্থানে আগে ডাকাতি হতো। বন কেটে বাজার করায় এখন ডাকাতি বন্ধ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নলুয়া বিট কর্মকর্তা আলাল উদ্দিন বলেন, বনের ভেতর ওইসব ঘর-বাড়ি আমি এ বিটে জয়েন্ট করার অনেক আগেই তোলা হয়েছে। তিনি বনের জমি দখল করে এয়ারফোর্স বাজারে কমপক্ষে একশ ঘর তোলার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের জানা রয়েছে।
টাঙ্গাইল বন বিভাগের বহেড়াতৈল রেঞ্জ কর্মকর্তা আতাউল মজিদ বলেন, সামাজিক বনায়নে ১০ বছর পর উপকারভোগীরা আর্থিক সুবিধা পায়, কিন্তু শাল গজারি বনে উপকারভোগীরা ২০ বছর পর পর পায়, ফলে উপকারভোগীরা শাল গজারি প্লট নিতে চায় না। তিনি দাবি করেন, বনের শাল গজারি গাছ এখন আর কেউ কাটে না। যেগুলো কাটা যায়, সেগুলো ব্যক্তি মালিকানা জমির শাল-গজারি। তারপরেও কোনো বিট কর্মকর্তা শাল-গজারি গাছ কাটার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।